রুহুল আমিন বাহিনী এক আতঙ্কের নাম

নোয়াখালীর সুবর্ণচর উপজেলার চরজুবিলী ইউনিয়নের গ্রামীণ জনপদে রুহুল আমিন এক আতঙ্কের নাম। ভোটের রাতে এক নারীকে সংঘবদ্ধ ধর্ষণ ঘটনার ইন্ধনদাতা হিসেবে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তার বাবা খুরশিদ আলম ছিলেন লক্ষ্মীপুর জেলার রামগতির চরাঞ্চলের ত্রাস।লক্ষ্মীপুর ও নোয়াখালী জেলার সীমানা নিয়ে বিরোধে ১৯৮০ সালে খুন হন বেচু। সেই মামলার প্রধান আসামি ছিলেন কুখ্যাত লাঠিয়াল খুরশিদ আলম। ওই ঘটনার পর ফেরারি হওয়ায় অসহায় হয়ে পড়ে তার পরিবার। ছেলে রুহুল আমিন কর্মচারীর কাজ নেন হারিছ চৌধুরী বাজারে রাহিন-মাহিন হোটেলে।কিছুদিন পর জেলা শহর মাইজদীর মোবারক মিয়ার বাসায় কাজ শুরু করেন। সেই সঙ্গে পাশের স্কুল থেকে এসএসসি পাস করেন। পরে সুবর্ণচর উপজেলার পাংখার বাজারে সততা নামে একটি স্থানীয় এনজিওতে চাকরি নেন রুহুল। সেখান থেকে অর্ধলাখ টাকা আত্মসাৎ করে তিনি ঢাকায় চলে যান এবং কারওয়ানবাজারে পাইকারি সবজি দোকানে কাজ নেন। অভিযোগ রয়েছে, সেখান থেকেও বেশ মোটা অঙ্কের টাকা আত্মসাৎ করে বরিশাল পালিয়ে যান। একসময় রুহুলের পরিচয় হয় অ্যাডভোকেট আতাউর রহমান নাছেরের সঙ্গে। তার সহায়তায় জেলা জজকোর্টে আইনজীবীর সহকারী হিসেবে কাজ শুরু করেন।সেই কাজের সুবাদে রুহুল আমিন একসময় এলাকার লোকজনের সঙ্গে সখ্য গড়ে তোলেন এবং আধিপত্য বিস্তার করতে থাকেন। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগে যোগ দিয়ে দায়িত্ব পান ওয়ার্ড সম্পাদকের। ২০১১ সালে চরজুবিলী ইউনিয়নের ৪ নম্বর ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য নির্বাচিত হন। এর পর তিনি এলাকায় অপরাধের রাজত্ব কায়েম করেন বলে অভিযোগ। বনদস্যু ও জলদস্যুদের সংগঠিত করে নিজের নামে গড়ে তোলেন ‘রুহুল আমিন বাহিনী’। তার এই বাহিনী দেখভাল করেন মূলত বনদস্যু হাসান আলী।তবে ত্রাসের রাজত্ব কয়েম করায় ২০১৬ সালের ইউপি নির্বাচনে হেরে যান রুহুল। কিন্তু এলাকায় তার প্রভাভ বিস্তার থেকেই যায়। পাংখারবাজারের পশ্চিমে তার নামে গড়ে তোলা হয় ‘রুহুল আমিন নগর’, রয়েছে বিলাসবহুল বাড়ি। অথচ ইউপি সদস্য নির্বাচিত হওয়ার আগে রুহুল ছিলেন একজন সাধারণ ভূমিহীন। প্রভাব খাটিয়ে একসময় তিনি ভাগিয়ে নেন সুবর্ণচর উপজেলা আওয়ামী লীগের প্রচার সম্পাদকের পদ। তবে উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি অ্যাডভোকেট ওমর ফারুক বলেন, ‘রুহুল আমিনকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। আমাদের সংগঠনে কোনো অপরাধীর ঠাঁই নেই। এই ঘৃণ্য ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির প্রয়োজন বলেও মনে করে দল।’এদিকে ধর্ষণের শিকার নারীর স্বামী ও মামলার বাদী বলেন, ‘গত ইউপি নির্বাচনে আমরা রুহুল আমিনের পক্ষে কাজ না করে তার ভাগ্নে খলিল উল্যার কর্মী ছিলাম। ভোটে খলিল উল্যা ইউপি সদস্য নির্বাচিত হন। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে রুহুল আমাকে দুইবার শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করে এবং বাড়ি গিয়ে আমার স্ত্রীকেও হুমকি দেয়।’ সাম্প্রতিক ঘটনা নিয়ে তিনি বলেন, ‘সংসদ নির্বাচনের দিন মধ্য বাগ্যা ১৪ নম্বর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে ভোট দেওয়াকে কেন্দ্র করে রাতে আমার বাড়িতে জোরপূর্বক প্রবেশ করে দুর্বৃত্তরা। তারা আমাকে এবং আমার সন্তানদের বেঁধে ফেলে। পরে আমার স্ত্রীকে জোর করে ঘরের বাইরে নিয়ে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের পর ফেলে রেখে যায়। আর এসব ঘটেছে রুহুল আমিনের নির্দেশেই। তার বাহিনীর লোকজনই এগুলো করেছে।’মামলায় আসামি ৯, গ্রেপ্তার ৭, পলাতক ৪মামলায় নয়জনকে আসামি করা হলেও ঘটনার মূল হুকুমদাতাসহ মোট সাতজনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। তবে এজাহারে নামোল্লেখ আরও চার আসামি এখনো পলাতক। গত কয়েক দিন পুলিশ নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, কুমিল্লা ও চট্টগ্রামের বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালিয়ে এজাহারভুক্ত আসামি বাদশা আলম বাসু, স্বপন, সোহেল, ভুলু, বেচু এবং ঘটনায় জড়িত থাকায় সুবর্ণচর উপজেলা আওয়ামী লীগের প্রচার সম্পাদক রুহুল আমিন মেম্বার ও জসিম উদ্দিন প্রকাশ জইস্যাকে গ্রেপ্তার করেছে।চরজব্বর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) নিজাম উদ্দিন জানান, বাদশা আলম, রুহুল আমিন মেম্বার ও বেচুকে শুক্রবার দুপুরে নোয়াখালী বিচারিক আদালত ২-এ হাজির করে সাত দিন করে রিমান্ড চাওয়া হয়। তখন আদালত বাদশা আলমের শুনানি আগামী রবিবার ধার্য করেন। বাকি দুজনের শুনানির দিন পরবর্তীতে জানানো হবে বলে জানান বিচারক।সর্বোচ্চ শাস্তি দাবি বাম জোট ও নাগরিক সমাজেরনোয়াখালী সদর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন গণধর্ষণের শিকার নারীর সঙ্গে দেখা করে তার পরিবারের পাশে থাকার আশ্বাস দিয়েছেন বাম গণতান্ত্রিক জোটের কেন্দ্রীয় নেতারা। পরে তারা সাংবাদিকদের জানান, ঘটনায় জড়িত মূল ইন্ধনদাতাদের নাম মামলার এজাহারে অন্তর্ভুক্ত করতে পুলিশ গড়িমসি করেছে। তাই এ ঘটনার তীব্র নিন্দা জানিয়ে অবিলম্বে তাদের নাম এজাহারে অন্তর্ভুক্ত করা, জড়িতদের দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে বিচার করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদান, ভুক্তভোগী পরিবারের নিরাপত্তা ও সামাজিক মর্যাদা নিশ্চিত করার দাবি জানান তারা।এ সময় উপস্থিত ছিলেন সিপিবির কেন্দ্রীয় সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স, বাসদের (মার্কসবাদী) কেন্দ্রীয় সদস্য শুভ্রাংশ চক্রবর্তী, বাসদের কেন্দ্রীয় সদস্য বজলুর রশিদ ফিরোজ, ইউনাইটেড কমিউনিস্ট লীগের পলিট ব্যুরোর সদস্য অধ্যাপক আবদুর সাত্তার, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির পলিট ব্যুরোর সদস্য আকবর খান, সিপিবির প্রেসিডিয়াম সদস্য লক্ষ্মী চক্রবর্তী, বাসদের (মাহবুব) কেন্দ্রীয় নেতা মহিন উদ্দিন লিটন প্রমুখ।এদিকে ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তির ব্যবস্থা করার দাবি জানিয়ে গতকাল শুক্রবার প্রেসক্লাবের সামনে মানববন্ধন করেছে সচেতন নাগরিক সমাজ। বক্তারা বলেন, সুবর্ণচর উপজেলার এক নারী সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। বিষয়টা এখন সবারই জানা। ওই নারীর দোষ, তিনি নিজের ভোট নিজেই দিয়েছেন। অথচ এটিই তার গণতান্ত্রিক অধিকার। এ দেশের প্রধানমন্ত্রী, প্রধান বিরোধী দলের নেত্রী এবং স্পিকার একজন নারী। এর পরও নারী নির্যাতন, নিপীড়ন, ধর্ষণ, যৌন হয়রানি কি কমেছে, নাকি আশঙ্কাজনক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে?ধর্ষকদের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবিতে মানববন্ধন করেছে ‘যৌন নিপীড়নবিরোধী শিক্ষার্থীজোট’। গতকাল বিকালে রাজধানীর জাতীয় জাদুঘরের সামনে হওয়া এ মানববন্ধনে বিভিন্ন বিশ^বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী, সচেতন নাগরিক ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অধ্যয়নরত নোয়াখালীর শিক্ষার্থীদের আঞ্চলিক সংগঠনের নেতারা উপস্থিত ছিলেন। একই দাবিতে বেলা ১১টায় ঢাবির রাজু ভাস্কর্যের সামনে মানববন্ধন করে জাসদ ছাত্রলীগ।