পাওনা টাকা চাওয়ায় খুন হন পারভীন

বছর দশেক আগের কথা। তিন সন্তানসহ পারভীন আক্তারকে ফেলে চলে যান তার স্বামী। শিশুসন্তানদের বাঁচাতে একপর্যায়ে পথে নামেন পারভীন; বাড়ি বাড়ি ফেরি করে কাপড় বিক্রি করতে শুরু করেন। কিন্তু সারাদিনের কঠোর পরিশ্রমের পরও সন্তানদের মুখে তিন বেলা আহার তুলে দিতে হিমশিম খাচ্ছিলেন পারভীন। অগত্যা পারভীন বাধ্য হয়ে বেছে নেন অন্ধকার পথ। কিন্তু তাতেও শেষরক্ষা হয়নি।খদ্দেরদের হাতে নৃশংসভাবে প্রাণ হারাতে হয়েছে ৩৫ বছর বয়সী এই নারীকে। গত ৩ সেপ্টেম্বর সকালে রাজধানীর খিলগাঁওয়ের উত্তর গোড়ান নবীনবাগ এলাকার একটি ম্যানহোল থেকে উদ্ধার করা হয়েছে তার বস্তাবন্দি অর্ধগলিত লাশ।পারভীন হত্যাকা-ে জড়িত খিলগাঁও থানা পুলিশের সোর্স মহসীন আহমেদ পল্লব এবং তার দুই বন্ধু ‘চাপাতি’ রাসেল ও ‘গুণ্ডা’ মাসুদকে গ্রেপ্তার করেছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি পূর্ব-বিভাগ) পুলিশ। তবে এতে জড়িত আরেক খুনি গ্রেপ্তারকৃত তিনজনের বন্ধু হারুন এখনো রয়ে গেছেন ধরাছোঁয়ার বাইরে। গ্রেপ্তার রাসেল ও মাসুদ আদালতে স্বাকীরোক্তিমূলক জবানবন্দিতে হত্যাকাণ্ডের চাঞ্চল্যকর তথ্য তুলে ধরেছেন। বলেছেন, যৌনবৃত্তির টাকা ভাগাভাগি নিয়ে সৃষ্ট বিরোধের জেরে পল্লব গলাটিপে হত্যা করেছেন পারভীন আক্তারকে। আর তার লাশ গুম করতে সহায়তা করেছেন গ্রেপ্তার তিন বন্ধু। হত্যাকা-ের আগে তারা সবাই একসঙ্গে বসে ইয়াবা সেবন করেন।এদিকে যে সন্তানদের বাঁচাতে শেষ পর্যন্ত দেহপসারিণীর খাতায় নাম লিখিয়েছিলেন পারভীন, মাকে হারিয়ে সেই তিন সন্তান এখন চরম মানবেতর জীবনযাপন করছে রাজধানীর যাত্রাবাড়ী থানাধীন মাতুয়াইলের ছোট্ট একটি ঘরে। সংসারের ভার সামাল দিতে পারভীনের মেয়েটি কাজ নিয়েছে পোশাক কারখানায়; বড় ছেলেটি এখন বাসের হেলপার আর ছোট ছেলেটি লেখাপড়ার পাঠ চুকিয়ে কাজের সন্ধানে হন্যে হয়ে ঘুরছে। তাদের মাথার ওপর থেকে সরে গেছে ছায়া, ভেঙে পড়েছে আকাশ।মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ডিবি পুলিশের খিলগাঁও জোনাল টিমের পরিদর্শক মো. আরিফুর রহমান আমাদের সময়কে জানান, বয়সে ব্যবধান থাকলেও গ্রেপ্তার পল্লব, রাসেল, মাসুদ ও হারুন (পলাতক) বন্ধুর মতোই চলাফেরা করতেন। তারা আড্ডা দেওয়ার পাশাপাশি একসঙ্গেই ইয়াবা সেবন করতেন। এর মধ্যে পল্লব মাদক ও যৌন কারবারে জড়িত ছিলেন। গত ২৯ আগস্ট রাতে চার বন্ধু গোড়ানের লাল মার্কেট এলাকায় দেলোয়ার মিয়ার নির্মাণাধীন বাড়ির একটি টিনশেড ঘরে ইয়াবা সেবনের পাশাপাশি যৌনাচারের সিদ্ধান্ত নেন।জনপ্রতি ৫০০ টাকা চাঁদা দিয়ে তারা এর আয়োজনও করেন। রাত ১০টার দিকে রাসেল ও মাসুদ ঘরে বসে ইয়াবা সেবন করেন। ১১টার দিকে মোবাইল ফোনে কল করে সেখানে পারভীনকে ডেকে আনেন পল্লব। কথা ছিল, ২ হাজার টাকার বিনিময়ে দুঘণ্টা দুই খদ্দেরের সঙ্গে সময় কাটাবেন পারভীন। এর পর হারুনের আনা ৮টি ইয়াবা বড়ির মধ্যে ৪টি সেবনের পর একে একে চারজনই পারভীনের সঙ্গে সময় কাটান। এর পর পারভীন ও পল্লবকে ঘরে রেখে বাকি ৪ পিস ইয়াবা ট্যাবলেট সেবন করতে পাশের ঘরে যান ৩ জন। এদিকে দুজনের পরিবর্তে ৪ জন হওয়ায় আরও দুই হাজার টাকা দাবি করেন পারভীন। এ নিয়ে পল্লবের সঙ্গে তার বাগবিতণ্ডা হয়। এরই একপর্যায়ে পারভীনকে গলা টিপে হত্যা করেন পল্লব।এর পর ৪ বন্ধু মিলে পারভীনের লাশ গুমে সচেষ্ট হন। প্রথমে তারা রামপুরার আফতাবনগরের নির্জন কোনো স্থানে লাশ ফেলার সিদ্ধান্ত নেন। ভোর রাতে পারভীনের নিথর দেহ নিয়ে রাস্তায় বেরিয়ে আসার পর রাস্তা দিয়ে একটি পুলিশের গাড়ি যেতে দেখে তারা ভয় পেয়ে যান। পরিকল্পনা পাল্টে নবীনবাগ এলাকার ৪০৯/৩ নম্বর বাসার পাশের ম্যানহোলে লাশ গুমের সিদ্ধান্ত নেন। এর পর বস্তা এনে লাশ ভরে ওই ম্যানহোলে পারভীনের মরদেহ ফেলে যার যার মতো বাসায় চলে যান।এর পর স্থানীয়দের মাধ্যমে খবর পেয়ে গত ৩ সেপ্টেম্বর ওই ম্যানহোল থেকে অচেনা হিসেবে পারভীনের অর্ধগলিত লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। এর দুদিন পর ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের মর্গে পারভীনের লাশ শনাক্ত করে তার সন্তান। এ ঘটনায় নিহতের বড় মেয়ে বাদী হয়ে ৪ সেপ্টেম্বর খিলগাঁও থানায় অজ্ঞাতনামাদের বিরুদ্ধে একটি হত্যা মামলা করে। মামলাটি ১৫ দিন খিলগাঁও থানা পুলিশ তদন্তের পর ডিবিতে হস্তান্তরিত হয়।পরিদর্শক আরিফুর রহমান জানান, লাশ উদ্ধারকালে ঘটনাস্থলেই পুলিশের সঙ্গে উপস্থিত ছিলেন পল্লব। এর আগে, ৪০ দিনের চিল্লায় যাচ্ছে জানিয়ে ঢাকা ছাড়েন রাসেল। পরে নিহত ও সন্দেহভাজনদের মোবাইল ফোন ট্র্যাক করে এবং গোপন সূত্র থেকে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে প্রথমে রাসেলকে আটক করা হয়। পরে তার তথ্য অনুযায়ী গ্রেপ্তার করা হয় অন্যদের। আদালতে দুজন স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিলেও চতুর পল্লব দায় এড়িয়ে গেছেন। পলাতক হারুণকে গ্রেপ্তারে গতকাল শনিবারও রাজধানীর একাধিক এলাকায় অভিযান চালানো হয়েছে। তাকে গ্রেপ্তারে চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।