চমক-চ্যালেঞ্জের মন্ত্রিসভা

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে চমক জাগানো বিজয়ের পর মন্ত্রিসভা গঠনেও ব্যাপক চমক দেখাতে যাচ্ছেন আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এবার তিনি আস্থা রাখছেন অনেক নতুন মুখের ওপর। এর পাশাপাশি দশম মন্ত্রিসভার অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে সরকার চালানোর চ্যালেঞ্জ নিয়েছেন শেখ হাসিনা। বিদায়ী সরকারের হেভিওয়েট মন্ত্রীদের অধিকাংশই এবারের মন্ত্রিসভায় স্থান পাননি।গত দুবার আওয়ামী লীগের জোটশরিক দলগুলোর নেতাদের মন্ত্রিসভায় রেখে সরকার গঠন করলেও এবার সব সদস্যই আওয়ামী লীগের। শরিক দলগুলোর একজনেরও ঠাঁই হয়নি ৪৭ সদস্যবিশিষ্ট মন্ত্রিসভায়। গতকাল রবিবার বিকালে সংবাদ সম্মেলন করে নতুন সরকারের মন্ত্রিসভার সদস্যদের নাম ও দপ্তর জানিয়ে দেন মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোহাম্মদ শফিউল আলম।বাংলাদেশে আগে কখনো এভাবে আগাম সংবাদ সম্মেলন করে নতুন মন্ত্রিসভার সদস্যদের নাম ঘোষণা হয়নি; চূড়ান্ত তালিকা জানতে তাদের শপথ অনুষ্ঠান পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হতো। এবার এর ব্যত্যয় ঘটিয়ে এক দিন আগেই দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রণালয়সহ মন্ত্রীদের নাম ঘোষণা করা হলো। ইতিপূর্বেই আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের জানিয়েছিলেন চমক থাকবে এবারের মন্ত্রিসভায়। গতকাল সত্যিই দেখা গেছে, দারুণ সেই চমক।
আজ সোমবার বিকালে বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ শপথ পড়াবেন মন্ত্রিসভার নতুন সদস্যদের। এর মধ্য দিয়ে যাত্রা শুরু হবে প্রধানমন্ত্রী পদে হ্যাটট্রিক করা শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন নতুন সরকারের।ঘোষিত তালিকা বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, প্রধানমন্ত্রীসহ নতুন মন্ত্রিসভা দাঁড়াচ্ছে ৪৭ সদস্যবিশিষ্ট। এর মধ্যে অর্ধেকেরও বেশি এবারই প্রথম মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী হচ্ছেন। বিদায়ী সরকারের ৩০ মন্ত্রী নতুন মন্ত্রিসভায় স্থান পাননি। আসন্ন মন্ত্রিসভার ২৪ মন্ত্রীর মধ্যে ৯ জন একেবারেই নতুন। বিদায়ী সরকারে না থাকলেও আগে মন্ত্রিসভায় দায়িত্ব পালন করেছেন এমন ৩ জনকে শেখ হাসিনা ফিরিয়ে এনেছেন পূর্ণমন্ত্রী হিসেবে। পুরনোদের মধ্যে ৭ মন্ত্রী নতুন সরকারেও আছেন। তাদের ৬ জনকেই আগের দপ্তরে রাখা হচ্ছে। এ ছাড়া গত সরকারের ৫ প্রতিমন্ত্রীর এবার পদোন্নতি হচ্ছে।বিদায়ী  মন্ত্রিসভায় টেকনোক্র্যাট মন্ত্রী ছিলেন ৪ জন। তাদের মধ্যে ২ জনকে এবারও রাখা হয়েছে। এ ছাড়া টেকনোক্র্যাট হিসেবে প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্বে আসছেন একজন। প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পেতে যাচ্ছেন এমন ১৯ জনের মধ্যে ১৫ জনই এই প্রথম সরকারে আসছেন। অবশিষ্টদের মধ্যে ৩ জন গত সরকারেও প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছেন। চতুর্থ জন নবম সংসদে গঠিত সরকারে থাকলেও দশম সংসদে অর্থাৎ গত মন্ত্রিসভায় ছিলেন না। এবারের সরকারে তিন মন্ত্রণালয়ে ৩ জন হচ্ছেন উপমন্ত্রী, যাদের সবাই নতুন মুখ।৪টি মন্ত্রণালয় ও ২টি বিভাগের বাড়তি দায়িত্বসহ প্রধানমন্ত্রী হিসেবে আজ শপথ নিতে যাচ্ছেন আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা। জনপ্রশাসন, প্রতিরক্ষা, বিদ্যুৎ জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ এবং মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে থাকছেন তিনি। এ ছাড়া মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ ও সশস্ত্র বাহিনী বিভাগের দায়িত্বও থাকছে তার হাতে। নিয়মানুযায়ী মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ সব সময় প্রধানমন্ত্রীর অধীনে থাকে। অন্য বিভাগ ও মন্ত্রণালয়গুলো তিনি চাইলে অন্যদের দায়িত্বে দিতে পারেন।মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পাচ্ছেন গত সরকারে একই দায়িত্বপ্রাপ্ত আ ক ম মোজাম্মেল হক। ওবায়দুল কাদেরও আগের সরকারের মতোই এবারও সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পাচ্ছেন। এবারও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী থাকছেন আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল। আইন বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী হিসেবে এবারও থাকছেন আনিসুল হক। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী হিসেবে এবারও টেকনোক্র্যাট কোটায় দায়িত্ব পেতে যাচ্ছেন ইয়াফেস ওসমান। তিনি এর আগেও একই মন্ত্রলালয়ের দায়িত্বে ছিলেন। ডাক টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী হিসেবে এবারও টেকনোক্র্যাট কোটায় দায়িত্ব পেতে যাচ্ছেন মোস্তাফা জব্বার।বিদায়ী সরকারের পরিকল্পনামন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল ওরফে লোটাস কামাল এবার অর্থ মন্ত্রণালয়ের পূর্ণমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে যাচ্ছেন। তিনি বিদায়ী সরকারের অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের স্থলাভিষিক্ত হচ্ছেন। স্থানীয় সরকার পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী হচ্ছেন কুমিল্লা-৯ আসনের সংসদ সদস্য তাজুল ইসলাম। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী হিসেবে শপথ নিতে যাচ্ছেন আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ডা. দীপু মনি। বিদায়ী সরকারে না থাকলেও নবম সংসদের মন্ত্রিসভায় পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্বে ছিলেন তিনি। কৃষি মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী হিসেবে আসছেন আওয়ামী লীগের সভাপতিম-লীর সদস্য ড. আবদুর রাজ্জাক। তিনি বিদায়ী সরকারের মন্ত্রিসভায় না থাকলেও নবম সংসদের মন্ত্রিসভায় খাদ্যমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। তথ্য মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী হিসেবে শপথ নিতে যাচ্ছেন আওয়ামী লীগের প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক ড. হাছান মাহমুদ। তিনি নবম সংসদে প্রথমে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী এবং পরবর্তী সময়ে বন ও পরিবেশমন্ত্রীর দায়িত্বে ছিলেন।স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী হিসেবে শপথ নেবেন জাহিদ মালেক, তিনি এর আগ একই মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন বিদায়ী সরকারে। বিদায়ী সরকারের প্রতিমন্ত্রী নুরুজ্জামান আহমেদ এবার পদোন্নতি পেয়ে সমাজকল্যাণ মন্ত্রীর দায়িত্ব নিতে যাচ্ছেন। পদোন্নতি পেয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী থেকে মন্ত্রী হতে যাচ্ছেন বীর বাহাদুর উ শৈ সিং। তিনি বিদায়ী সরকারে এই মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী ছিলেন। ভূমিমন্ত্রী হতে যাচ্ছেন দশম সংসদে একই মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদ।সিলেট-১ আসন প্রথমবারের মতো নির্বাচিত হয়ে সংসদে এসেই পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রিত্ব পেতে যাচ্ছেন একে আবদুল মোমেন। তিনি বিদায়ী সরকারের অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের ছোট ভাই। পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী হতে যাচ্ছেন বিদায়ী সরকারের অর্থ প্রতিমন্ত্রী এমএ মান্নান। শিল্প মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পাচ্ছেন নরসিংদীর একাধিকবার নির্বাচিত সংসদ সদস্য আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য নূরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ুন। বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পাচ্ছেন নারায়ণগঞ্জের এমপি বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা গোলাম দস্তগীর গাজী বীরপ্রতীক। খাদ্য মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নিতে যাচ্ছেন সাধনচন্দ্র মজুমদার। তিনি বিদায়ী সরকারের খাদ্যমন্ত্রী অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলামের স্থলাভিষিক্ত হতে যাচ্ছেন।বাণিজ্যমন্ত্রী হিসেবে আসছেন রংপুর থেকে একাধিকবার নির্বাচিত আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির অর্থ ও পরিকল্পনাবিষয়ক সম্পাদক টিপু মুনশি। আওয়ামী লীগের আইনবিষয়ক সম্পাদক শ ম রেজাউল করিম প্রথমবারের মতো সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েই গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী হচ্ছেন। পরিবেশ বন ও জলবায়ু মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী হতে যাচ্ছেন গত সংসদের হুইপ শাহাব উদ্দিন। রেলপথ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী হতে যাচ্ছেন নুরুল ইসলাম সুজন।
নতুন সরকারের প্রতিমন্ত্রীদের মধ্যে আগের মতোই থাকছেন শাহরিয়ার আলম (পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়), নসরুল হামিদ বিপু (বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়) এবং জুনাইদ আহমেদ পলক (তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়)। এর সঙ্গে যোগ হচ্ছেন কামাল আহমেদ মজুমদার-শিল্প মন্ত্রণালয়, ইমরান আহমেদ  চৌধুরী-প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়, জাহিদ আহসান রাসেল-প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়, আশরাফ আলী খান খসরু-মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়, মুন্নুজান সুফিয়ান-শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়, আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক খালিদ মাহমুদ চৌধুরী-নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়, জাকির হোসেন-প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়, ফরহাদ হোসেন-জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়, স্বপন ভট্টাচার্য্য-স্থানীয় সরকার পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়, জাহিদ ফারুক-পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়, মুরাদ হাসান-স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়,  শরীফ আহমেদ-সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়, কেএম খালিদ-সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়, এনামুর রহমান-দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়, মাহবুব আলী-বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়, টেকনোক্র্যাট কোটায় ধর্ম প্রতিমন্ত্রী হয়েছেন শেখ মোহাম্মদ আব্দুল্লাহ।নতুন সরকারের উপমন্ত্রী হিসেবে শপথ নিতে যাচ্ছেন তিনজন। এদের মধ্যে হাবিবুন নাহার-পরিবেশ বন  ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়, একেএম এনামুল হক শামীম-পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় এবং  মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল-শিক্ষা মন্ত্রণালয়।নতুন ও অপেক্ষাকৃত তারুণ্যনির্ভর মন্ত্রিসভা সরকারের কাজে আরও গতি আনবে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য রাশিদুল আলম আমাদের সময়কে বলেন, মন্ত্রিসভা ভালো হয়েছে। নতুন এই মন্ত্রিসভা মূল্যায়নের জন্য আমাদের কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে। আশা করি নতুনরা ভালো করবেন।