সিলেটের আতিয়া মহলে জঙ্গিবিরোধী অভিযান চলাকালে ঘটনাস্থলের অদূরে জোড়া বিস্ফোরণে নিহত হন র্যাবের গোয়েন্দা শাখার তৎকালীন প্রধান লে. কর্নেল আবুল কালাম আজাদ এবং দুই পুলিশ কর্মকর্তা।প্রায় দুই বছর চলা দীর্ঘ তদন্তের পর সেই বিস্ফোরণকাণ্ডের সব তথ্য জানতে পেরেছে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। সর্বশেষে তথ্য হচ্ছে, এ দুই মামলার চার্জশিট চূড়ান্তপ্রায়। চার্জশিটে অভিযুক্ত হিসেবে তদন্তকারী সংস্থাটি ১৭ জঙ্গির নাম উল্লেখ করেছে।পিবিআইয়ের ভাষ্য, আতিয়া মহলে জঙ্গিবিরোধী অভিযান শুরু হলে জঙ্গিরাও পরিকল্পনা করে মাল্টিপল (একাধিক) হামলার। এর পর জঙ্গিরা ঘটনাস্থলের অদূরে বোমা বিস্ফোরণ ঘটায়। এতে নিহত হন র্যাব ও পুলিশের চৌকস তিন কর্মকর্তা এবং সাধারণ মানুষসহ ৭ জন। বিস্ফোরণ ঘটানো জঙ্গিদের দ্বিতীয় এ দলটিকে ‘ব্যাকআপ টিম’ হিসেবে চিহ্নিত করে পুলিশ।র্যাব-পুলিশের কর্মকর্তারা বলছেন, সিলেটের আতিয়া মহলের পাশে এ জোড়া বিস্ফোরণকা-ের আগে দেশে কখনো জঙ্গিদের মাল্টিপল হামলা করতে দেখা যায়নি।বোমা বিস্ফোরণে নিহত কর্মকর্তাদের পরিবার-স্বজনের আক্ষেপ, ঘটনার দুই বছর পরও তাদের প্রিয়জন হারানোর বিচার শুরু হয়নি। তারা এ হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের ফাঁসি দাবি করছেন। এ ছাড়া দেশ যখন পুরোপুরি জঙ্গিমুক্ত হবে, তখন তাদের সর্বোচ্চ ত্যাগের (কর্মকর্তাদের প্রাণ হারানো) ন্যূনতম মূল্যায়ন হবে বলে মনে করেন তারা।সিলেটের আলোচিত এ ঘটনায় নগরের মোগলাবাজার থানায় দুটি মামলা করা হয়। একটি হত্যা মামলা, অন্যটি বিস্ফোরক আইনে। প্রথমে থানাপুলিশের পাশাপাশি ঘটনার ছায়া তদন্তে নামে র্যাব এবং ঢাকা মহানগর পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিট (সিটিটিসি)। একপর্যায়ে মামলার তদন্তভার পায় পিবিআই।তদন্ত সংস্থা সূত্র জানায়, তৎকালে নব্য জেএমবির চট্টগ্রাম বিভাগের সমন্বয়ক হিসেবে দায়িত্ব পালনকারী অন্যতম জঙ্গি নেতা মোশারফ হোসেন ওরফে সোহেলের পরিকল্পনায় চলমান অভিযানের মধ্যে ‘দ্বিতীয়’ এ বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটানো হয়। এ জন্য তারা দফায়-দফায় বৈঠকও করে। বিস্ফোরণের সময় ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিল নাজিম উদ্দিন ও অচেনা আরেক জঙ্গি।হামলায় সরাসরি ও নেপথ্যে অংশগ্রহণে মোট ১৭ জঙ্গির সম্পৃক্ততা পেয়েছে পিবিআই। তাদের মধ্যে সিলেট ও মৌলভীবাজারে জঙ্গিবিরোধী বিভিন্ন অভিযানে ১৪ জঙ্গি নিহত হয়েছে। জীবিত আছে তিন জঙ্গি। চার্জশিটের পর জীবিত তিন জঙ্গির বিচার কার্যক্রম শুরু হবে। তবে মামলার তদন্তের এ পর্যায়ে কৌশলগত কারণে সব আসামির নাম-পরিচয় প্রকাশ করতে চাইছে না তদন্ত সংস্থা। আগামী এক থেকে দেড় মাসের মধ্যে চার্জশিট দাখিল করার লক্ষ্য নিয়ে এগোচ্ছে পিবিআই।সূত্র জানায়, সিলেটে আতিয়া মহলে অভিযানের পর মৌলভীবাজারের একটি জঙ্গি আস্তানায় তিন জঙ্গি নিহত হয়। সেখানে সিলেটের হামলায় থাকা জঙ্গি নাজিম ও অজ্ঞাত পরিচয়ের আরেক জঙ্গি নিহত হয়। পরে অজ্ঞাত ওই জঙ্গিকে বেওয়ারিশ হিসেবে দাফন করা হয়। পরিচয় শনাক্তের জন্য তার লাশের ডিএনএ নমুনা সংগ্রহ করা হলেও এ পর্যন্ত পরিচয় জানা যায়নি।আতিয়া মহলে অভিযান শেষ হওয়ার পরপরই মৌলভীবাজারে দুটি জঙ্গি আস্তানার খবর পায় পুলিশ। ২০১৭ সালের ৩০ মার্চ নাসিরপুরে অপারেশন ‘হিটব্যাক’ এবং ১ এপ্রিল বড়হাটের অপর একটি জঙ্গি আস্তানায় অভিযান পরিচালনা করে সিটিটিসি ইউনিট। অভিযানের পর একটি আস্তানায় ৭ এবং অপর আস্তানায় ৩ জঙ্গির লাশ মেলে। নিহত এ ১০ জঙ্গি এবং সিলেটের আতিয়া মহলে নিহত ৪ জঙ্গি র্যাব-পুলিশের ৩ কর্মকর্তাকে হত্যার ঘটনায় জড়িত ছিলেন বলে পিবিআইর তদন্তে উঠে এসেছে। এ ঘটনায় জড়িত জীবিত তিন জঙ্গিকে চট্টগ্রামের একটি জঙ্গি আস্তানা থেকে গ্রেপ্তার করে সিটিটিসির সদস্যরা।সূত্র জানায়, প্রাসঙ্গিক হওয়ায় মৌলভীবাজারের জঙ্গি হামলার ঘটনায় দায়ের হওয়া মামলার সঙ্গে সমন্বয় করা হচ্ছে র্যাব-পুলিশের তিন কর্মকর্তা নিহত হওয়ার মামলা দুটি। মামলাগুলোর তদন্ত কর্মকর্তারা তথ্য আদান-প্রদানও করছেন।এ বিষয়ে জানতে চাইলে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ও পিবিআই সিলেট ব্যুরোর পরিদর্শক দেওয়ান আবুল হোসেন আমাদের সময়কে বলেন, র্যাব-পুলিশের ৩ কর্মকর্তা নিহতের ঘটনার সঙ্গে জঙ্গিদের সম্পৃক্ততার তথ্য উদ্ঘাটিত হয়েছে। তদন্তে যথেষ্ট অগ্রগতি রয়েছে। হামলাকারীদের কার কী ভূমিকা ছিল, সেটি বিস্তারিত তুলে ধরা হবে চার্জশিটে।২০১৭ সালের ২৫ মার্চ সন্ধ্যায় সিলেট শহরের দক্ষিণ সুরমা এলাকার আতিয়া মহলের জঙ্গি আস্তানায় সেনা অভিযানের মধ্যে জঙ্গি হামলায় র্যাবের গোয়েন্দাপ্রধান লে. কর্নেল আবুল কালাম আজাদ ও দুই পুলিশ কর্মকর্তাসহ ৭ জন নিহত হন; আহত হন ৪০ জনেরও বেশি। উন্নত চিকিৎসার জন্য সিঙ্গাপুরে নিয়েও বাঁচানো যায়নি র্যাবের তৎকালীন গোয়েন্দাপ্রধানকে। এ ঘটনায় নিহত দুই পুলিশ কর্মকর্তা হলেন- জালালাবাদ থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মনিরুল ইসলাম সোহেল ও এসবির পরিদর্শক চৌধুরী মো. আবু কয়ছর।আতিয়া মহলে শ্বাসরুদ্ধকর ১১১ ঘণ্টার অভিযানে নিহত হয় দুর্ধর্ষ চার জঙ্গি। চূড়ান্ত অভিযান অপারেশন টুয়াইলাইট শুরুর আগে পাঁচতলা ওই ভবনের ২৯টি ফ্ল্যাট থেকে নারী-শিশুসহ ৭৮ জনকে সরিয়ে নেন সেনাবাহিনীর কমান্ডোরা। অভিযানকালে অন্তত ১৩ বার বিকট শব্দে বিস্ফোরণ ঘটায় জঙ্গিরা। ঘটনার দায় স্বীকার করে বার্তা দেয় মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক জঙ্গি সংগঠন আইএস।এ বিষয়ে নিরাপত্তা বিশ্লেষক ও ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের ভিক্টিমোলজি অ্যান্ড রেস্টরেটিভ জাস্টিস বিভাগের সহকারী অধ্যাপক তৌহিদুল হক আমাদের সময়কে বলেন, এ রকম একটি ঘটনার চার্জশিট হচ্ছে, অপরাধীদের আইনের মুখোমুখি করা হচ্ছে, এটি বিচারের সংস্কৃতি তৈরিতে একটি ইতিবাচক দিক বলে মনে করি। তবে অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, একটি হামলার ঘটনা ঘটলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তৎপরতা বেড়ে যায়। পরে তা ঝিমিয়ে পড়ে।কিন্তু জঙ্গিদের বিরুদ্ধে এ তৎপরতা সব সময়ই বাড়াতে হবে। এ ছাড়া সামাজিক ও রাজনৈতিকভাবে তাদের মোকাবিলায় জোরালো ভূমিকা রাখতে হবে।
নিহত লে. কর্নেল আবুল কালাম আজাদের ছোট ভাই মো. ইউসুফ হাসান হিমেল আমাদের সময়কে বলেন, ভাই হারানোর যন্ত্রণা বোঝানো যাবে না। আমরা শুধু বলব, এ ঘটনায় দায়ীদের ফাঁসি দেওয়া হোক।