আওয়ামী লীগ তৃণমূলের খেয়ালখুশির নাম কেন্দ্রে

আসন্ন উপজেলা নির্বাচনে প্রার্থী বাছাইয়ে তৃণমূল থেকে নাম চেয়েছিল আওয়ামী লীগ। কেন্দ্র থেকে এ বিষয়ে নির্দেশনাও দেওয়া হয় জেলায় জেলায়। কিন্তু অধিকাংশ জেলায় কেন্দ্রের এ নির্দেশনা মানা হয়নি। গঠনতন্ত্র অমান্য করে জেলা, উপজেলা এবং ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের নেতাদের সঙ্গে পরামর্শ না করেই স্থানীয় সংসদ সদস্যরা চেয়ারম্যান পদে খেয়ালখুশি মতো নাম পাঠিয়েছেন কেন্দ্রে। অনেক ক্ষেত্রে নিজেদের পছন্দের প্রার্থীকে নির্বাচন করে কেন্দ্রে পাঠানো হয়েছে। নির্বাচন বা সমঝোতার ভিত্তিতে নাম পাঠানোর বদলে মনোনয়নবাণিজ্যের অভিযোগও উঠেছে অনেক জেলা ও উপজেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের নামে। এ বিষয়ে বিস্তর অভিযোগ আসা শুরু হয়েছে দলের সভাপতির রাজনৈতিক কার্যালয়ে। দলটির কেন্দ্রীয় নেতারা বলছেন, সব অভিযোগ তদন্ত করে তৃণমূলের নামের সঙ্গে কেন্দ্রের জরিপের সমন্বয় করে মনোনয়ন চূড়ান্ত করা হবে। উপজেলা নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর পরই আওয়ামী লীগ সভাপতির রাজনৈতিক কার্যালয় থেকে দলটির প্রতিটি সাংগঠনিক জেলায় নির্বাচনের প্রার্থীদের নাম চেয়ে চিঠি পাঠানো হয়। চিঠিতে উল্লেখ করা হয়, ‘দলের গঠনতন্ত্রের ২৮(৪) ধারা মোতাবেক জেলা, উপজেলা ও ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ নেতাদের পরামর্শ গ্রহণ করে জেলা এবং উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকদের (৪ জন) স্বাক্ষরে উপজেলা চেয়ারম্যান এবং উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান ও মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান পদের জন্য ঐকমত্যের ভিত্তিতে প্রার্থী অথবা অনধিক ৩ জনের একটি প্রার্থী তালিকা ৬ ফেব্রুয়ারির (আজ) মধ্যে কেন্দ্রে পাঠাতে হবে।’ তালিকার সঙ্গে প্রার্থীদের জাতীয় পরিচয়পত্রের ফটোকপিও পাঠাতে বলা হয় ওই চিঠিতে। সারাদেশে খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, বেশিরভাগ জেলা এবং উপজেলায় কোনো রকম আলাপ-আলোচনা বা নির্বাচন ছাড়াই পছন্দের প্রার্থীদের নাম কেন্দ্রে পাঠিয়ে দিয়েছেন জেলা ও উপজেলা আওয়ামী লীগের শীর্ষ চার নেতা। এ ক্ষেত্রে স্থানীয় ও দলীয় সংসদ সদস্য বা মন্ত্রীদের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছেন তারা। অনেক জেলায় আবার বিত্তশালী প্রার্থীরা টাকার বিনিময়ে জেলা ও উপজেলার নেতাদের ম্যানেজ করে নিজেদের নাম কেন্দ্রে পাঠিয়েছেন। এবারের উপজেলা নির্বাচনে কমবেশি প্রায় সব উপজেলায় মনোনয়নবাণিজ্যের অভিযোগও পাওয়া যাচ্ছে। এর ফলে তৃণমূলে জনপ্রিয়তা থাকলেও অনেক জনপ্রিয় প্রার্থীর নাম আসেনি কেন্দ্রে। তাদের কেউ কেউ এ বিষয়ে অভিযোগ জানিয়ে চিঠি পাঠিয়েছেন আওয়ামী লীগ সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের কাছে। অনেকে আবার ভয়ে চিঠি না পাঠিয়ে ঢাকায় এসে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতাদের বাড়ি এবং অফিসে ধরনা দিয়ে বেড়াচ্ছেন। আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় ও স্থানীয় নেতাদের সঙ্গে কথা বলে এবং বিভিন্ন উপজেলায় খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্রায় সারাদেশেই উপজেলা নির্বাচনের প্রার্থীদের নাম পাঠানোর ক্ষেত্রে অনিয়মের ঘটনা ঘটেছে। পাবনা জেলার আটঘরিয়া উপজেলায় চেয়ারম্যান পদপ্রার্থী তানভীর ইসলাম। ছাত্রলীগের টানা দুই কেন্দ্রীয় কমিটির সাবেক এ নেতা কয়েক বছর ধরেই উপজেলা নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। অথচ তৃণমূল থেকে নাম পাঠানোর সময় তানভীরের নামই কেন্দ্রে পাঠাতে চাননি জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও স্থানীয় সংসদ সদস্য শামসুর রহমান শরীফ ডিলু। সব শেষে জেলা আওয়ামী লীগের অন্য নেতাদের চাপে মোট তিনজন চেয়ারম্যান প্রার্থীর নাম কেন্দ্রে পাঠান তিনি। এই তালিকায় এক নম্বরে রাখা হয়েছে সাবেক মন্ত্রী শামসুর রহমান শরীফ ডিলুর প্রার্থী হিসেবে পরিচিত ইশারত আলীকে। তিনি এর আগে ২০০৯ সালে উপজেলা নির্বাচনে বিএনপি-জামায়াতের সমর্থিত প্রার্থী হিসেবে চেয়ারম্যান পদে নির্বাচন করেন। ১/১১-এর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় দলের বিরুদ্ধে কাজ করায় তাকে বহিষ্কার করা হয়। সর্বশেষ ২০১৬ সালের ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে ইশারত আলীর আপন ছোট ভাই আবু হানিফ ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করেন। ওই নির্বাচনে তার ভাইয়ের পক্ষে ধানের শীষে ভোট চান। এখন তাকেই উপজেলা চেয়ারম্যান পদে নৌকা মার্কা দিতে উঠেপড়ে লেগেছেন স্থানীয় এমপি। এমপি নাখোশ হবে বলে তালিকায় নাম থাকা অন্য দুজন চেয়ারম্যান প্রার্থী এ বিষয়ে কেন্দ্রে অভিযোগও করেননি। তারা এখন কেন্দ্রের সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় চেয়ে আছেন। এ বিষয়ে জানতে চাইলে শামসুর রহমান শরীফ ডিলু আমাদের সময়কে বলেন, কেন্দ্রের নির্দেশ অনুযায়ী সব নিয়ম মেনে প্রার্থীদের নাম পাঠানো হয়েছে। অনিয়মের অভিযোগ তিনি অস্বীকার করেন। পটুয়াখালী সদর উপজেলার চেয়ারম্যান পদে তিনজনের নাম সুপারিশ করে পাঠানো হয়েছে কেন্দ্রে। তালিকায় প্রথম যার নাম এসেছে, তিনি স্থানীয় এমপি শাহজাহান মিয়ার ছেলে তারিকুজ্জামান মনি। তালিকার দুই নম্বর প্রার্থী এমপির ভাইয়ের ছেলে আবুল কালাম মৃধা। এই তালিকায় তিন নম্বর প্রার্থী হিসেবে জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদকের নাম রাখা হয়েছে। পার্শ্ববর্তী মির্জাগঞ্জ উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান পদে এক নম্বরে সুপারিশ করা হয়েছে স্থানীয় এমপির বেয়াই গাজী আতাহারউদ্দীনের নাম। তিনি শাহজাহান মিয়া এমপির ছোট ছেলে তারিকুজ্জামান রনির শ্বশুর। বর্তমান উপজেলা চেয়ারম্যানকে তালিকার তিন নম্বরে রাখা হয়েছে। দিনাজপুর জেলার খানসামা উপজেলায় চেয়ারম্যান পদের জন্য যে তালিকা কেন্দ্রে পাঠানো হয়েছে, তার মধ্যে দুজনের বিষয়ে অভিযোগ জমা পড়েছে আওয়ামী লীগ সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের কাছে। জেলা আওয়ামী লীগের একজন সদস্য লিখিত ওই অভিযোগ করেছেন। অভিযোগপত্রে তিনি অনুরোধ জানিয়েছেন, আসন্ন উপজেলা নির্বাচনে খানসামা উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শফিউল আযম চৌধুরী এবং শহিদুজ্জামান শাহকে যেন দলীয় মনোনয়ন না দেওয়া হয়। রাজশাহী জেলার বাঘা উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে দলীয় মনোনয়ন চান রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক এসএম তৌহিদ আল তুহিন। ইসলামী ছাত্রশিবিরের ক্যাডারদের হাতে নির্যাতিত তুহিন এখনো শরীরে পঙ্গুত্ব বহন করে চলছেন। চাপাতির ৫৫টি কোপ খেয়ে বেঁচে যাওয়া তুহিন গত ২৮ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত বাঘা উপজেলা আওয়ামী লীগের বর্ধিত সভায় উপস্থিত হয়ে উপজেলা নির্বাচনের প্রার্থিতার বিষয়ে নিজের আগ্রহের কথা জানান। কিন্তু উপজেলা থেকে যে তিনজনের নাম জেলা আওয়ামী লীগের কাছে পাঠানো হয়, সেখানে নিজের নাম না থাকায় জেলা আওয়ামী লীগের কাছে চিঠি দিয়েছেন তুহিন। চিঠিতে তিনি বলেছেন, বাঘা উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নিজেই প্রার্থী হওয়ায় তাদের নাম সুপারিশ করেননি। চট্টগ্রামের সাতকানিয়া ও লোহাগড়ায় প্রার্থীদের নাম পাঠানোর ক্ষেত্রে স্থানীয় এমপির সুপারিশকেই প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। নামমাত্র বর্ধিত সভা করে কোনো নির্বাচন ছাড়াই এমপি তার পছন্দের প্রার্থীদের নাম কেন্দ্রে পাঠিয়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মফিজুর রহমান আমাদের সময়কে বলেন, আমরা স্থানীয় নেতারা ও সংসদ সদস্যদের সঙ্গে দফায় দফায় আলোচনা করে প্রার্থীদের নাম দিয়েছি। আওয়ামী লীগের স্থানীয় সরকার মনোনয়ন বোর্ডের সদস্যদের সঙ্গে আলাপকালে জানা গেছে, উপজেলা নির্বাচন নিয়ে সারাদেশ থেকে তাদের কাছে নানা অভিযোগ আসছে। বড় দল হওয়ার কারণে অনেকেই নির্বাচন করতে চান, সে কারণে অভিযোগও আসছে বেশি। তবে তৃণমূলের সুপারিশ করা নামের ভিত্তিতেই প্রার্থী চূড়ান্ত করা হবে না। প্রার্থী চূড়ান্তের ক্ষেত্রে তৃণমূল থেকে পাঠানো নাম, আওয়ামী লীগের নিজস্ব জরিপ এবং সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থার জরিপকে আমলে নেওয়া হবে। এসব বিষয় বিবেচনা করে আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন মনোনয়ন বোর্ড উপজেলা নির্বাচনের চেয়ারম্যান, ভাইস চেয়ারম্যান এবং মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান পদ চূড়ান্ত করবে। আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, তৃণমূল থেকে নাম পাঠানোর সময় কেউ কোনো অনিয়ম করল কিনা, সেটা দেখবে আমাদের মনোনয়ন বোর্ড। সঠিকভাবে নাম না এলে দলের জরিপ আছে। সব মিলিয়ে আমরা মনোনয়ন দেব। শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে মনোনয়ন বোর্ড বসবে। সবকিছু বিচার-বিশ্লেষণ করে যাচাই-বাছাই করে জনগণের কাছে অধিকতর গ্রহণযোগ্য ব্যক্তিকেই আমরা উপজেলায় মনোনয়ন দেব।