সরকারি চাকরিতে ৪ লাখ পদ শূন্য

সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোয় শূন্যপদের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, বিভাগ ও দপ্তরে এখন তিন লাখ ৯৯ হাজার ৮৯৭টি পদ শূন্য রয়েছে। এগুলো প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির। শূন্যপদের সংখ্যা বৃদ্ধির পেছনে বিলম্বিত নিয়োগ প্রক্রিয়া ও কর্মকর্তাদের উদ্যোগের অভাবকে দায়ী করছেন বিশ্লেষকরা।শূন্যপদ পূরণে প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ নির্দেশনা থাকলেও চাকরিদাতা-সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর তৎপরতা খুব বেশি চোখে পড়ে না। দু-চারটা মন্ত্রণালয় ও বিভাগ জনবল নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করলেও নিয়োগে দীর্ঘ সময় লেগে যাচ্ছে। বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশন (পিএসসি) জনবল নিয়োগের প্রক্রিয়া সহজ করতে পারেনি। প্রতিষ্ঠানটির মাধ্যমে প্রধানত বিসিএস ক্যাডার নিয়োগ দেওয়া হয়। নন-ক্যাডার পদের লোকবলও নিয়োগ দেয় পিএসসি। এসব পদে নিয়োগ দিতে বিজ্ঞপ্তি জারির পর তিন বছরের বেশি সময়ও লেগে যায়।জানা গেছে, গত বছরের ৯ জুলাই সমাজসেবা অধিদপ্তর ৯৬০ জন নিয়োগ দিতে বিজ্ঞপ্তি দেয়। দীর্ঘ সময় পরও এ নিয়োগ প্রক্রিয়া এখনো শুরুই হয়নি। একই বছরের ১১ জুলাই এক হাজারেরও বেশি জনবল নিয়োগ দিতে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে খাদ্য অধিদপ্তর। অথচ এখন পর্যন্ত নিয়োগ পরীক্ষা গ্রহণ করতে পারেনি কর্তৃপক্ষ। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়েরও বেশ কয়েকটি বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ হয়েছে। তবে এখনো সেগুলোর বিপরীতে নিয়োগ প্রক্রিয়া শেষ হয়নি। ফলে শূন্যপদের সংখ্যা কমছে না; বরং কর্মকর্তারা অবসর নেওয়ার কারণে শূন্যপদ বেড়েই চলেছে।খাদ্য অধিপ্তরের নিয়োগ প্রক্রিয়া কেন বিলম্বিত হচ্ছে- এমন প্রশ্নে প্রতিষ্ঠানটির পরিচালক (প্রশাসন) একেএম ফজলুর রহমান বলেন, বিলম্বিত নয়। নতুন মন্ত্রিসভার ক্রয়সংক্রান্ত কমিটির অনুমোদন পেলেই আমরা দ্রুত নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে পারব। শিগগিরই স্বনামধন্য কোনো প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে এ নিয়োগ সম্পন্ন করা হবে।কর্মকর্তারা জানান, নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি জারির পর সুপারিশ চূড়ান্ত করতে পিএসসি সময় নেয় গড়ে আড়াই বছর। এর পর স্বাস্থ্য পরীক্ষা ও পুলিশি তদন্তের জন্য লাগে ৮-৯ মাস। সব মিলিয়ে বিজ্ঞপ্তি জারির পর চাকরিতে যোগদান পর্যন্ত সময় লাগছে তিন বছরের বেশি। এতে একদিকে চাকরিপ্রার্থীদের মধ্যে হতাশা দেখা দিচ্ছে। অন্যদিকে সরকারি দপ্তরগুলো জনবলের অভাবে তাদের স্বাভাবিক কাজকর্ম চালিয়ে নিতে হিমশিম খাচ্ছে।জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের ২০১৭ সালের সর্বশেষ পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগে প্রথম শ্রেণির ৭৬৪টি, দ্বিতীয় শ্রেণির ৮৭৬, তৃতীয় শ্রেণির এক হাজার ৪৭২ ও চতুর্থ শ্রেণির ৮৫৪টি পদশূন্য। অধিদপ্তর ও বিভাগে প্রথম শ্রেণির ২৬ হাজার ৫৩৮, দ্বিতীয় শ্রেণির ৩৪ হাজার ৯৯২, তৃতীয় শ্রেণির এক লাখ ৫১ হাজার ২৪২, চতুর্থ শ্রেণির ৪৫ হাজার ৫১৬টি পদ খালি।বিভাগীয় কমিশনার, জেলা প্রশাসক, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেদের (ভূমি) কার্যালয়ে প্রথম শ্রেণির ৬৭৮, দ্বিতীয় শ্রেণির ৪৮৯, তৃতীয় শ্রেণির ৫ হাজার ৬৮৯ এবং চতুর্থ শ্রেণির পদ ৪ হাজার ৫৩৪টি পদ শূন্য। স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান ও বিভিন্ন করপোরেশনে প্রথম শ্রেণির ২০ হাজার ৮১৩, দ্বিতীয় শ্রেণির ২৮ হাজার ৭২৬, তৃতীয় শ্রেণির ৪৮ হাজার ৩৫৭ এবং চতুর্থ শ্রেণির ২৮ হাজার ৩৫৭ পদ খালি।পরিসংখ্যান বলছে, ২০১৩ সালে সরকারি চাকরিতে শূন্যপদ ছিল দুই লাখ ৭৬ হাজার ৫৮৭। পরের বছর এ সংখ্যা দাঁড়ায় তিন লাখ ২ হাজার ৯০৪। ২০১৫ সালে তিন লাখ ২৮ হাজার ৩১১ এবং পরের বছর তিন লাখ ৫৯ হাজার ২৬১ পদ খালি ছিল। সবশেষ ২০১৭ সালে শূন্যপদের সংখ্যা দাঁড়ায় ৩ লাখ ৯৯ হাজার ৮৯৭টিতে।জানা গেছে, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে শূন্যপদ সবচেয়ে বেশি, ৫১ হাজার ১২২টি। দ্বিতীয় স্থানে আছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, সেখানে ৪৩ হাজার ৯৮৩টি পদ খালি। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে ৪০ হাজার ৭৩৪টি, অর্থ মন্ত্রণালয়ে ২৫ হাজার ২৪৯, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে ১৬ হাজার ২৯৪ এবং রেলপথ মন্ত্রণালয়ে ১৩ হাজার ১১২টি পদ খালি।ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগে ৫০ হাজার ৪৬৬টি, কৃষি মন্ত্রণালয়ে ৭ হাজার ৯৪৭, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে ২৯২, সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ে ৭ হাজার ৬৩৮, সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ে ৩০৫, প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ে ৫ হাজার ২৯২, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ে ৯০৭, সংসদ সচিবালয়ে ৫৬১, বন, পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক মন্ত্রণালয়ে ৩ হাজার ৭৫৮, প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ে ৯৫৩, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ে ৩ হাজার ৬৯২, খাদ্য মন্ত্রণালয়ে ৪ হাজার ৯৬৫, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ৫টি, গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ে ১ হাজার ৬৫২, শিল্প মন্ত্রণালয়ে ৬২টি, তথ্য মন্ত্রণালয়ে ২ হাজার ২৭৯, বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ে ৭০৬, শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ে ৭৮৭, ভূমি মন্ত্রণালয়ে ৪ হাজার ৪০, আইন বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয়ে ১ হাজার ৯৪৯, স্থানীয় সরকার পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ে ৩ হাজার ৮২৬, ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্য প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ে ৭ হাজার ৫০৯, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে ২ হাজার ১৩৮, পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ে ১ হাজার ৯১৩, বিদ্যুৎ ও জ¦ালানি মন্ত্রণালয়ে ৩৩৬, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে ৪৭৫, ধর্ম মন্ত্রণালয়ে ৯, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ে ৮, নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ে ১০২, সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ে ১ হাজার ৬১৭, যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ে ১ হাজার ৩১৭টি পদ খালি।কর্মকর্তারা জানান, শূন্যপদের সংখ্যা বাড়ার ফলে প্রতিষ্ঠানগুলো কাজের গতি হারাচ্ছে। অন্যদিকে চাকরি না পেয়ে বেকারের সংখ্যাও বাড়ছে। দ্রুত এসব শূন্যপদে নিয়োগ দিতে পারলে সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলো আরও গতিশীল হবে। পাশাপাশি শিক্ষিত বেকার তরুণ-তরুণীরা চাকরির সুযোগ পাবে।টানা তৃতীয়বার প্রধানমন্ত্রী হয়ে এবার জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে নিজের হাতে রেখেছেন শেখ হাসিনা। নতুন মন্ত্রিসভা শপথ নেওয়ার পর গত ১৭ জানুয়ারি জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় পরিদর্শন করেন তিনি। এ সময় প্রধানমন্ত্রী জনপ্রশাসনে খালি থাকা পদগুলো দ্রুত পূরণের নির্দেশ দেন। তার নির্দেশনা অনুযায়ী সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়, বিভাগ ও অন্যান্য দপ্তরে জনবল নিয়োগে পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানানো হবে বলে গণমাধ্যমকে জানিয়েছিলেন জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন।সরকারি চাকরিতে শূন্যপদ প্রশাসনের গতি হ্রাস করে মন্তব্য করে সাবেক সচিব সিরাজুল হক খান আমাদের সময়কে বলেন, আমি মনে করি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন তারুণ্যনির্ভর মন্ত্রিসভা নিয়োগ প্রক্রিয়া দ্রুত সম্পন্ন করার পদক্ষেপ নেবে। এতে সরকারের নির্বাচনী ইশতেহার ঘরে ঘরে চাকরি দেওয়ার প্রতিশ্রুতির বাস্তবায়ন হবে। তিনি বলেন, শূন্যপদ পূরণ না করে ফেলে রাখা এক ধরনের বিলাসিতা। এ বিলাসিতা চলতে থাকলে আমাদের বেকারত্বের হার আরও বাড়বে।নিয়োগ প্রক্রিয়া কেন বিলম্বিত হয়- এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, পিএসসির মাধ্যমেই বেশিরভাগ নিয়োগ হয়ে থাকে। প্রতিষ্ঠানটির কাজের পরিধি এত বেশি যে, তারা সারা বছর কাজ করেও সময়মতো নিয়োগ প্রক্রিয়া শেষ করতে পারে না। এ ক্ষেত্রে সরকারের বিকল্প চিন্তা করা দরকার বলেও মনে করেন সিরাজুল হক খান।