জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) আমদানিনীতির আদেশ অনুযায়ী সিগারেটের প্যাকেটের গায়ে বাংলায় ধূমপানবিরোধী সতর্কীকরণ বার্তা ব্যতীত বিদেশি সিগারেট আমদানি করা নিষিদ্ধ। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে দেশের চোরাকারবারি চক্র বিদেশ থেকে কৌশলে স্থল ও আকাশপথে সতর্কীকরণ বার্তা ছাড়া সিগারেট নিয়ে আসছে। শুল্ক ফাঁকি দিয়ে আনা হচ্ছে বলে এসব সিগারেটের দামও অনেক কম। রাজধানী তো বটেই, দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলেও এখন মিলছে ডানহিল, ব্ল্যাক, এসএস, ইউন, গুডান গরাম, গোল্ড লিফ কিংবা প্যারিসের মতো নামকরা ব্র্যান্ডের চোরাই সিগারেট। এতে করে প্রতিবছর হাজার কোটি টাকার রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে সরকার।শুল্ক ফাঁকি দেওয়া এবং এনবিআরের সতর্কীকরণ বার্তা যুক্ত না-থাকা এসব বিদেশি সিগারেটের চোরাচালান ঠেকাতে নড়েচড়ে বসেছে প্রশাসন। ইতোমধ্যে দেশের বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালিয়ে বেশ কয়েকটি চক্রকে শনাক্ত করেছে পুলিশের অপরাধ বিভাগ সিআইডির অর্গানাইজড ক্রাইমের সদস্যরা। ইতোমধ্যে রংপুর ও নীলফামারীর ৪টি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে মামলা করেছে সিআইডি; গ্রেপ্তার করা হয়েছে কয়েক জনকে। এসব সিগারেটের চোরাচালান ঠেকাতে বেশ কিছু তথ্য-উপাত্তসহ দিকনির্দেশনা দিয়ে সম্প্রতি অর্থ মন্ত্রণালয় চিঠি দিয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে। এরই ধারাবাহিকতায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে সিআইডিকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়ার।অর্থ মন্ত্রণালয়ের চিঠিতে উল্লেখ করা হয়েছে, সিগারেট খাত থেকে ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ১৯ হাজার ৪৪০ কোটি টাকা রাজস্ব সংগৃহীত হয়েছে। চলতি অর্থবছরে এ খাত থেকে আরও বেশি রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য রয়েছে। কিন্তু এতে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে চোরাচালানের মাধ্যমে আনা বিভিন্ন ব্র্যান্ডের বিদেশি সিগারেট। চীন, সংযুক্ত আরব আমিরাত, ইন্দোনেশিয়া, মিয়ানমার, কোরিয়া, যুক্তরাষ্ট্রসহ ২০টিরও বেশি দেশ থেকে ৪০ ব্র্যান্ডের বিদেশি সিগারেট বিভিন্ন বন্দর হয়ে চোরাইভাবে দেশে প্রবেশ করে জনস্বাস্থ্যের হুমকির পাশাপাশি সরকারকে রাজস্ব হুমকির মধ্যে ফেলেছে। আইন অনুযায়ী এসব সিগারেটের প্যাকেটের গায়ে নেই বাংলা ভাষায় মুদ্রিত কোনো স্বাস্থ্য সতর্ক বার্তা; নেই স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় কর্তৃক নির্ধারিত সচিত্র সতর্ক বাণী। বিদেশি সিগারেট আমদানি শুল্ক প্রতি প্যাকেটে ৫৯৬.৫৮ শতাংশ হলেও অবৈধভাবে বিদেশি সিগারেট বাজারজাতকরণের ফলে সরকার হারাচ্ছে বিপুল পরিমাণ রাজস্ব। এর পাশাপাশি গত এক বছরে স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত রাজস্ব ফাঁকি দেওয়া সিগারেটের সংখ্যাও ব্যাপক হারে বেড়েছে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এসব সিগারেটের গায়ে নকল অথবা পুনঃব্যবহৃত ট্রাক্স স্ট্যাম্প বা ব্যান্ডরোল ব্যবহৃত হচ্ছে। ফলে সরকার হারাচ্ছে রাজস্ব। তুলনামূলক কম দামে পাওয়ায় দেশের যুবসমাজ ও সাধারণ মানুষ এসব সিগারেটে আসক্ত হয়ে পড়ছে। এতে মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে প্রণীত তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন।চিঠিতে আরও উল্লেখ করা হয়, শুধু যে বিদেশ থেকে সিগারেট চোরাচালান হচ্ছে তাই নয়, দেশের প্রত্যন্ত এলাকায় কারখানা বানিয়ে সেখানেও তৈরি হচ্ছে নকল সিগারেট। ওই সব কারখানায় নকল অথবা পুনঃব্যবহৃত ট্যাক্স বা ব্যান্ডরোল লাগিয়ে সিগারেট বাজারজাত করে রাজস্ব ফাঁকি দেওয়া হচ্ছে। তদন্তে দেখা গেছে, বাংলাদেশে তামাকের অবৈধ বাণিজ্যের কারণে সরকার বছরে ৮০০ থেকে ১ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব হারাচ্ছে। এ অবস্থায় সিগারেট খাতের রাজস্ব গুরুত্ব এবং সিগারেটের ক্ষতিকর প্রভাব বিবেচনায় চোরাচালান রোধে সীমান্তবর্তী জেলায় বিজিবি, কোস্টগার্ড, পুলিশ, জেলা প্রশাসনসহ সব জেলা প্রশাসনের বাড়তি নজরদারি প্রয়োজন।শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ড. মোহাম্মদ শহীদুল ইসলাম আমাদের সময়কে বলেন, বিদেশ থেকে যেসব পণ্য আমদানি করা হয়, তার মধ্যে সিগারেটও রয়েছে। আমদানি আইন অনুযায়ী সিগারেটের গায়ে ‘ধূমপান স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর’ যদি না লেখা থাকে, তা হলে সেটি আমদানি করা যায় না। কিন্তু চোরাকারবারিরা নানা কৌশলে আমদানি-নিষিদ্ধ সিগারেট দেশে নিয়ে আসছে। এসব সিগারেট ক্রেতাদের অধিকাংশই উচ্চবিত্ত শ্রেণির। সিগারেটগুলো অভিজাত বিপণি বিতান ও পাঁচতারকা হোটেলে বিক্রি হয়। কর ফাঁকি দিয়ে অবৈধভাবে বিদেশ থেকে যেসব পণ্য বাংলাদেশে আমদানি করা হয়, সেগুলো ধরতে দীর্ঘদিন ধরে অভিযান চালাচ্ছে শুল্ক গোয়েন্দা। ২০১৬ সালের জুলাই থেকে ২০১৭ সালের অক্টোবর পর্যন্ত সারাদেশ থেকে ২.৭৮ কোটি শলাকা সিগারেট আটক করা হয়। জব্দকৃত এসব শলাকার বাজারমূল্য ৪৩.৬৩ কোটি টাকা। গত বছর ও চলতি বছরও সমপরিমাণে সিগারেট জব্দ করা হয়েছে। জব্দকৃত সিগারেটের অধিকাংশই ইউরোপের ব্র্যান্ড ডানহিল, মন্ড ও কিংসের। এসব ব্র্যান্ডের সিগারেটের প্রতি দেশের উচ্চবিত্ত শ্রেণির ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। এ ধরনের অভিযান অব্যাহত থাকবে বলেও জানান মহাপরিচালক ড. শহীদুল ইসলাম।সিআইডির অর্গানাইজড ক্রাইমের বিশেষ পুলিশ সুপার মোল্যা নজরুল ইসলাম আমাদের সময়কে বলেন, রাজস্ব ফাঁকি দেওয়া প্রতিষ্ঠান ও চক্রের বিরুদ্ধে তাদের অভিযান অব্যাহত থাকবে।গত বছরের শেষদিকে রংপুরের হাজীরহাট থানাধীন গোপীনাথপুর নজিরেরহাটে এসভি টোব্যাকো নামে একটি প্রতিষ্ঠানের সন্ধান পায় সিআইডি। ওই প্রতিষ্ঠান থেকে রাজস্ব ফাঁকি দিয়ে নকল অথবা পুনঃব্যবহৃত ট্যাক্স বা ব্যান্ডরোল লাগিয়ে সিগারেট বাজারজাত করে আসছিল একটি চক্র। সিআইডি সেখানে অভিযান চালিয়ে জব্দ করে ৩ হাজার ৩শ পিস নকল ব্যান্ডরোল বা স্ট্যাম্প; ৮৫টি পুনঃব্যবহৃত ট্যাক্স বা ব্যান্ডরোল। গ্রেপ্তার করা হয় মো. আবুল মাখদুম নামে ওই চক্রের এক সদস্যকে। এ বিষয়ে গত ২৮ অক্টোবর রংপুরের হাজিরহাট থানায় একটি মামলা করেন সিআইডির অর্গানাইজড ক্রাইম ইকোনমিক স্কোয়াডের এসআই আবু সালেহ মো. আসাদ। একই দিন সিগারেট চোরাচালানিদের বিরুদ্ধে রংপুরের গঙ্গাচড়া মডেল থানায় একটি মামলা করেন সিআইডির অর্গানাইজড ক্রাইম ইকোনমিক স্কোয়াডের এসআই মো. আসাদুজ্জামান সুইট।মামলা সূত্রে জানা গেছে, গত ২৭ অক্টোবর গঙ্গাচর থানাধীন খলেয়া গঞ্জীপুর বাজারসংলগ্ন মেসার্স স্প্যানিস টোব্যাকো ইন্ডাস্ট্রিজ নামের একটি প্রতিষ্ঠানে অভিযান চালিয়ে সিআইডির অর্গানাইজড ক্রাইম ইকোনমিক স্কোয়াডের সদস্যরা ৭৫০ পিস নকল ট্যাক্স স্ট্যাম্প এবং ২০০টি পুনঃব্যবহৃত ট্যাক্স স্ট্যাম্প, ৪ কার্টনে বিপুল পরিমাণ পুনঃব্যবহৃত ট্যাক্স স্ট্যাম্প ও সিগারেট জব্দ করে। গ্রেপ্তার করা হয় ওই প্রতিষ্ঠানের সিকিউরিটি ইনচার্জ স্বপন মিয়াকে।সিআইডির জিজ্ঞাসাবাদে স্বপন জানান, স্প্যানিস টোব্যাকো ইন্ডাস্ট্রিজের মালিক আক্তারুল ইসলাম ভরসা। ডিজিএম রায়হান, রুম ইনচার্জ নুরুল আমিন, স্টোরকিপার ইনচার্জ হলেন খায়রুল। চক্রটি দীর্ঘদিন ধরে রাজস্ব ফাঁকি দিয়ে নকল ট্যাক্স ব্যান্ডরোল ও পুনঃব্যবহৃত ট্যাক্স স্ট্যাম্প ব্যবহার করে আসছিল। এদের সঙ্গে বিদেশি একটি চক্রও জড়িত বলে জিজ্ঞাসাবাদে জানান স্বপন।
সর্বশেষ
সুনামগঞ্জে বিদ্যুৎস্পৃষ্টে যুবকের মৃত্যু
দর্পন টিভি - 0
সুনামগঞ্জের শাল্লায় বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে এক যুবকের মৃত্যু হয়েছে।
মঙ্গলবার (১৫ নভেম্বর) সকালে উপজেলার জনস্বাস্থ্যের নির্মাণাধীন ভবনের দ্বিতীয় তলার ছাদে...