
বিভিন্ন সময় দেশে বেশ কিছু অগ্নিকা-ের ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনা পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, জানমালের ক্ষতি নির্ধারণ ও দায়ীদের চিহ্নিত করা গেলেও তারা থেকে গেছেন ধরাছোঁয়ার বাইরে। অগ্নিকাণ্ড এবং এসব ঘটনায় হতাহতদের সুনির্দিষ্ট তথ্য পাওয়া না গেলেও সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন গত দুই দশকে দুই হাজারেরও বেশি মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন। এসব ঘটনায় দায়ীদের বিরুদ্ধে মামলা হলেও সহজেই তারা জামিনে মুক্তি পান। এর পর সাক্ষ্যপ্রমাণের অভাবে ওই মামলা বছরের পর ঝুলে থাকে। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) ও বিভিন্ন সংস্থার হিসাবমতে, গত দুই দশকে বাংলাদেশে শিল্প-কারখানায় ২৬টির বেশি দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন দুই হাজারের মতো শ্রমিক ও সাধারণ নাগরিক। অধিকাংশ ঘটনায় দোষীদের চিহ্নিত করে মামলাই হয়নি। যে দু-একটি ঘটনায় মামলা হয়েছে, তার বিচার শেষ হয়নি। ২০১২ সালের ২৪ নভেম্বর আশুলিয়ার নিশ্চিন্তপুরে তাজরীন ফ্যাশনসে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় সরকারি হিসেবে ১১২ শ্রমিক মারা যান। ওই ঘটনার পর আশুলিয়া থানাপুলিশ দায়িত্বে অবহেলার জন্য তাজরীন ফ্যাশনসের মালিকসহ ১৩ জনের বিরুদ্ধে মামলা করেন। ২০১৩ সালের ১৯ ডিসেম্বর মামলার চার্জশিট দেওয়া হয় হয়। ২০১৫ সালের ৩ সেপ্টেম্বর আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করা হয়। এর পর গত সাড়ে তিন বছরে ১০৪ সাক্ষীর মধ্যে মাত্র আটজনের সাক্ষ্য নেওয়া হয়েছে। সাধারণ আদালতে বিচার চলায় দুই-তিন মাস পর পর সাক্ষ্যগ্রহণের তারিখ দেওয়া হয়। আবার ধার্য তারিখে রাষ্ট্রপক্ষ সাক্ষ্যও হাজির করছে না। এভাবেই চলছে বিচার। ফলে মামলার বিচার কবে শেষ হবে কেউ বলতে পারছে না। ঢাকার প্রথম অতিরিক্ত জেলা জজ আদালতে বিচার চলছে। এ মামলার রাষ্ট্রপক্ষের অতিরিক্ত পাবলিক প্রসিকিউটর কাজী শাহানারা ইয়াসমিন বলেন, চার্জশিটে সাক্ষীদের যে ঠিকানা দেওয়া আছে, সেখানে সমন ও ওয়ারেন্ট পাঠানো হলেও পুলিশ তাদের পাচ্ছে না। তাই সাক্ষী হাজির করা যাচ্ছে না। ২০১০ সালের ৩ জুন পুরান ঢাকার নিমতলীতে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে নিহত হন ১৩০ জন। তাজরীনের ঘটনায় মামলা হলেও নিমতলীর ঘটনায় গত ৯ বছরে কারও বিরুদ্ধে কোনো মামলাই হয়নি। দায়ীদের বিচারের তো প্রশ্নই আসে না। সূত্র জানায়, নিমতলীর দুর্ঘটনার পর তদন্ত কমিটি হয়েছিল। টাস্কফোর্স গঠন করা হয়। তারা যে প্রতিবেদন দিয়েছিলেন, তাতে ওই দুর্ঘটনার জন্য কারা দায়ী, তা সঠিকভাবে চিহ্নিত করা হয়নি। ফলে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। তবে ওই ঘটনার পর মোবাইল কোর্ট পরিচালনার মাধ্যমে লাইসেন্সবিহীন কেমিক্যাল ব্যবসার অভিযোগে ২০১০ সালের ১৬ জুন জনৈক অহিদুল্লাহ মজুমদারের বিরুদ্ধে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তর আদালতে একটি মামলা হয়। ৬২/২ পুরাতন বিকে গাঙ্গুলী লেন, মাজেদ সরদার রোডে আবু বকর জামে মসজিদের নিচতলায় লাইসেন্স ছাড়া বিস্ফোরক মজুদ পাওয়ায় মামলাটি করা হয়। ওই মামলায় আসামিকে আদালতে হাজির হওয়ার জন্য সমন জারি করা হয়। কিন্তু মামলাটির বিচার সম্পন্ন হয়েছে কিনা তা জানা যায়নি। পরিসংখ্যানে আরও দেখা যায়, ১৯৯০ সালের ১৭ ডিসেম্বর মিরপুরের সারেকা গার্মেন্টে আগুনে পুড়ে মারা যান ২৭ জন। ১৯৯৫ সালে রাজধানীর ইব্রাহিমপুরের লুসাকা অ্যাপারেলসে নিহত হন ১০ কর্মী। ১৯৯৬ সালে ঢাকার তাহিদুল ফ্যাশনে ১৪ এবং সানটেক্স লিমিটেডের কারখানায় ১৪ জন আগুনে পুড়ে মারা যান। ১৯৯৭ সালে ঢাকার মিরপুরের তামান্না গার্মেন্টে ২৭ ও মিরপুর মাজার রোডের রহমান অ্যান্ড রহমান অ্যাপারেলস কারখানায় অগ্নিদগ্ধ হয়ে নিহত হন ২২ শ্রমিক। ২০০০ সালের ২৫ নভেম্বর নরসিংদীর চৌধুরী নিটওয়্যার লিমিটেডে আগুনে দগ্ধ হয়ে মারা যান ৫৩ শ্রমিক। একই বছর রাজধানীর বনানীর চেয়ারম্যানবাড়ীতে গ্লোব নিটিং ফ্যাশন লিমিটেডে আগুন লেগে মারা যান ১২ শ্রমিক। ২০০১ সালের ৮ আগস্ট ঢাকার মিরপুরের মিকো সোয়েটার লিমিটেডে আগুন ধরার গুজবে ভিড়ে পায়ের নিচে চাপা পড়ে নিহত হন ২৪ শ্রমিক। তারও এক সপ্তাহ আগে মিরপুরের কাফরুলে অগ্নিকা-ে আরও ২৬ শ্রমিক মারা যান। ২০০৪ সালের ডিসেম্বরে নরসিংদীর শিবপুরে গার্মেন্ট কারখানায় অগ্নিকা-ে ৪৮ শ্রমিক নিহত হন। ওই বছরের ৩ মে মিসকো সুপারমার্কেট কমপ্লেক্সের একটি গার্মেন্টে আগুন লাগলে মারা যান ৯ শ্রমিক। ২০০৫ সালের ৭ জানুয়ারি নারায়ণগঞ্জের গোদনাইল সান নিটিং নামে একটি গার্মেন্ট কারখানায় আগুনে ২০ শ্রমিকের মৃত্যু হয়। ২০০৬ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রামের কেটিএস অ্যাপারেলস মিলে আগুন লেগে ৬৫ শ্রমিক পুড়ে মারা যান। ২০১০ সালের ফেব্রুয়ারিতে গাজীপুর সদরের গরিব অ্যান্ড গরিব সোয়েটার ফ্যাক্টরিতে অগ্নিকা-ে মারা যান ২১ শ্রমিক। একই বছরের ১৪ ডিসেম্বর আশুলিয়ায় হামীম গ্রুপের গার্মেন্ট ফ্যাক্টরিতে আগুনে পুড়ে ৩০ শ্রমিক মারা যান। ২০১৬ সালের ১০ সেপ্টেম্বর টঙ্গীর ট্যাম্পাকো ফয়েলস নামে একটি প্যাকেজিং কারখানার বয়লার বিস্ফোরণের পর সৃষ্ট আগুনে ৪০ বছরের পুরনো ভবনটি ধসে পড়ে। এতে নিহত হন ৩৫ জন। এর অধিকাংশ ঘটনাই মামলা হয়নি।