পুরান ঢাকার ৭/১১ নম্বর গোলাম মোস্তফা লেনের তিনতলা আবাসিক ভবনের নিচতলার একপাশে বিশাল গুদাম এবং আরেক পাশে দুটি দোকান। গুদামের ভেতর সকাল থেকে রাত পর্যন্ত মেশিনও চলে। স্থানীয়রা অবশ্য এটিকে প্লাস্টিক দানা ভাঙানোর মিল বলেই চেনেন। আবাসিক এলাকার মধ্যে হলেও ভবনটিতে বাণিজ্যিক, রাসায়নিক গুদামজাত ও কারখানাÑ সবই চলে। ওপরের দুই তলায় ফ্যামিলি বাসা। ফলে ভবনটিতে যে রাসায়নিক গুদাম ও কারাখানা আছে, তা বুঝার উপায় নেই। গতকাল শুক্রবার সকালে সরেজমিন ঘুরে এমনটাই দেখা গেছে। তবে শুধু এ বাড়িটিই নয়, পুরান ঢাকার ৮০ শতাংশের বেশি ভবনে একসঙ্গে চলে আবাসিক-বাণিজ্যিক কার্যক্রম। গোলাম মোস্তফা লেনের এক বাসিন্দা জানান, এটিসহ আশপাশের সব এলাকাই আবাসিক। কিন্তু এখানকার বেশ কিছু বাড়ির নিচতলায় কেমিক্যালের গোডাউন ও কারখানা রয়েছে। যেসব বাড়ির নিচতলায় সকাল থেকে রাত পর্যন্ত মেশিনের শব্দ মেলে সেটি যে কারখানা, তা বুঝা যায়। তবে এমন অনেক বাড়িতে গুদাম থাকলেও বাইরে থেকে দেখে বুঝার উপায় নেই। শুধু পণ্য ঢুকানো ও বের করার সময়ই স্থানীয়রা দেখতে পান। আবার যাদের বাড়িতে গুদাম বা কারখানা রয়েছে তারা প্রভাবশালী। তাদের বিরুদ্ধে কেউ প্রতিবাদ করার সাহসও দেখান না। কেএম আজম লেন, আগাসাদেক রোড, মাজেদ সরদার রোড ও চানখাঁরপুলের প্রায় সব বাসাতেই একই চিত্র। সরেজমিন দেখা যায়, আগাসাদেক মোড়ে তিনতলার ছোট একটি বাড়ির ভেতরে মেশিন চলছে। তবে কারখানার দরজা বন্ধ থাকায় কী কাজ চলছে তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি। ওই রোডের ৮৪ নম্বর বাড়ির উল্টো পাশে একটি পাকা ভবন ও একটি টিনশেড বাড়িতে রয়েছে কারখানা। সেখানে কী উৎপাদন হয়, এক শ্রমিককের কাছে জানতে চাইলে তিনি কথা বলতে রাজি হননি। এখানকার আরও কয়েকটি ভবন ও টিনশেড ঘরে গুদাম ও কারখানা রয়েছে। দুপুরে মাজেদ সরদার রোডে গিয়ে দেখা যায়, হজরত আবু বকর (রা) মসজিদের পাশে একটি টিনশেড ভবনের ভেতর মেশিন চলছে। ভবনের দরজা বাইরে থেকে বন্ধ। দেয়াল ঘেঁষে রয়েছে বড় আকারের দুটি ট্রান্সমিটার। এ ছাড়া মাজেদ সরদার রোডের নিমতলী ও চানখাঁরপুল লেন এলাকায় রয়েছে অনেক প্লাস্টিক কারখানা। স্থানীয়রা জানান, পুরান ঢাকার বেশিরভাগ ভবনের ওপরতলায় মানুষ বসবাস করলেও নিচতলায় রাসায়নিক গুদাম ও কারখানা। আবার দুপাশে আবাসিক ভবন মাঝখানে টিনশেড বাড়িতে কারাখানা ও গুদামঘর রয়েছে, যা জনজীবনের জন্য ভয়াবহ হুমকি ও ঝুঁকিপূর্ণ। এগুলোয় অগ্নিকা-ের ঘটনা ঘটলে প্রাণ হারাবেন আবাসিক ভবনের মানুষই। তারা আরও জানান, ঘনবসতিপূর্ণ পুরান ঢাকার অনেক ভবনেই একসঙ্গে শিল্পকারখানা, রাসায়নিক দাহ্য পদার্থসহ বিভিন্ন মালামালের গুদাম, দোকান ও আবাসিক ফ্ল্যাট রয়েছে। অলিগলিতে গড়ে উঠছে রাসায়নিকের গুদাম, কারখানা, প্লাস্টিক ও পলিথিন কারখানা, দোকান। এসব প্রতিষ্ঠানে অগ্নি নির্বাপণের নিজস্ব কোনো ব্যবস্থাও নেই। সরু রাস্তা হওয়ায় অগ্নিকা-ের পর ফায়ার সার্ভিসের গাড়িগুলোও দুর্ঘটনাস্থলে পৌঁছতে পারে না। আবার অনেক সময় অগ্নিকা-স্থলের কাছে জলাধার না থাকায় পানির অভাবে ফায়ার সার্ভিসকে বেশ বেগ পেতে হয়। রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) উপনগর পরিকল্পনাবিদ ও ডিটেইল্ড এরিয়া প্ল্যান (ড্যাপ) প্রকল্পের পরিচালক মো. আশরাফুল ইসলাম বলেন, ‘পুরান ঢাকার ৯০ শতাংশেরও বেশি ভবনের অনুমোদন নেই। আবার ৮০ শতাংশের বেশি স্থাপনায় একসঙ্গে চলে আবাসিক-বাণিজ্যিক কার্যক্রম। আমাদের কাছে যে তথ্য আছে, তাতে ওই অঞ্চলে ২৪ হাজারের বেশি স্থাপনা রয়েছে। এর মধ্যে ১১ হাজার ভবন একতলাবিশিষ্ট। বাকিগুলো দোতলা থেকে শুরু করে বহুতল পর্যন্ত।’ তিনি আরও বলেন, ‘আগের ম্যাপে পুরান ঢাকার কিছু এলাকাকে মিস্কড জোন হিসেবে উল্লেখ করা আছে, কিন্তু বর্তমানে সেখানকার বাসিন্দারা বেশিরভাগ এলাকাকেই মিস্কড জোন হিসেবে ব্যবহার করছে।’ একটি সূত্র জানায়, ঢাকা মহানগরীতে হাজার হাজার রাসায়নিক গুদাম, দোকান ও কারখানা রয়েছে। এর মধ্যে বেশিরভাগই পরিচালিত হচ্ছে অবৈধভাবে। পরিবেশ সংরক্ষণ আইন-১৯৯৫ অনুযায়ী, আবাসিক এলাকায় রাসায়নিক গুদাম ও কারখানা পরিচালনার কোনো সুযোগ নেই। আর রাসায়নিক কারখানা, গুদাম পরিচালনার ক্ষেত্রে পরিবেশ অধিদপ্তর, জেলা প্রশাসন, বিস্ফোরক অধিদপ্তর, শ্রম অধিদপ্তর, ফায়ার সার্ভিস, সিটি করপোরেশনের ছাড়পত্র বা লাইসেন্স গ্রহণের বিধান রয়েছে। সেই সঙ্গে আলাদাভাবে বিদ্যুৎ ও গ্যাস সংযোগের প্রয়োজন। কিন্তু এ নিয়মের তোয়াক্কা করছে না কেউই। বর্তমানে পুরান ঢাকার কী পরিমাণ বাড়িতে রাসায়নিক গুদাম, দোকান ও কারখানা রয়েছে তার সঠিক কোনো পরিসংখ্যান নেই। তবে ওই অঞ্চলে রাসায়নিক গুদাম, দোকান, কলকারখানা শনাক্তে ২০০৯-২০১০ সালে একটি জরিপ পরিচালনা করে পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন (পবা)। তাতে পুরান ঢাকায় দুই হাজারের বেশি কলকারখানা এবং ২২ হাজার গুদাম ও দোকান রয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়। বর্তমানে এ সংখ্যা অনেক বেড়েছে বলে জানায় পবা। প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান আবু নাসের খান বলেন, ‘পুরান ঢাকার বাড়ির মালিকরা বেশি টাকা পাওয়ার আশায় আবাসিক ভবনগুলোকে গুদামঘর বা কারাখানা জন্য ভাড়া দিচ্ছেন। যারা এ কাজ করছেন তারা অর্থনৈতিকভাবে খুবই শক্তিশালী, সেই সঙ্গে রাজনৈতিকভাবেও। ফলে আবাসিক এলাকা থেকে কারখানা, রাসায়নিক, গুদামঘর সরিয়ে নেওয়ার কোনো আইন করার চেষ্টা হলেই বাধা দেয়। এ কারণে তাদের সরানো যাচ্ছে না। তবে আবাসিক এলাকা থেকে রাসায়নিক গুদাম, দোকান ও কারখানা সরাতে সরকারকেই কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে। আর যদি তা না হয় তা হলে নিমতলী, চকবাজারের মতো মানবসৃষ্ট ঘটনা বাড়তেই থাকবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘পুরান ঢাকা থেকে বিপজ্জনক রাসায়নিক পদার্থের গুদাম, কারখানা ও দোকান সরিয়ে নেওয়ার দাবিতে পবা দীর্ঘদিন ধরেই আলোচনাসভা, গোলটেবিল বৈঠক, মানববন্ধন করে যাচ্ছে। বিশেষ করে ২০১০ সালে নিমতলীর অগ্নিকা-ের পর তা আরও গতি পায়। ২০১০ সালে সরকার আমাদের দাবি মেনে তা সরিয়ে নেওয়ার আশ্বাসও দেয়, কিন্তু সেটি আর বাস্তবায়িত হয়নি। নিমতলী দুর্ঘটনার পর যদি আবাসিক এলাকা থেকে রাসায়নিক পদার্থের গুদাম সরিয়ে নেওয়ার ব্যবস্থা করত, তা হলে এ ঘটনা এত ভয়াবহ হতো না।’ রাজউকের সাবেক প্রধান প্রকৌশলী মো. এমদাদুল ইসলাম বলেন, ‘পুরান ঢাকা একটি ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা। ২০১০ সালে ওই এলাকাকে পুনর্গঠনের উদ্যোগও নেওয়া হয়েছিল। তখন রাজউক, সিটি করপোরেশন ও গণপূর্ত অধিদপ্তর এ সংস্থার প্রধান প্রকৌশলীদের সমন্বয়ে একটি কমিটি গঠন করা হয়। পুরান ঢাকাকে একটি পরিকল্পিত নগরী হিসেবে গড়ে তোলা সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদন দাখিল করে সেই কমিটি। কিন্তু পুরান ঢাকাবাসী রাজি না হওয়ায় তা বাস্তবায়ন করা যায়নি।’
সর্বশেষ
সুনামগঞ্জে বিদ্যুৎস্পৃষ্টে যুবকের মৃত্যু
দর্পন টিভি - 0
সুনামগঞ্জের শাল্লায় বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে এক যুবকের মৃত্যু হয়েছে।
মঙ্গলবার (১৫ নভেম্বর) সকালে উপজেলার জনস্বাস্থ্যের নির্মাণাধীন ভবনের দ্বিতীয় তলার ছাদে...