দেশের প্রধান বিমানবন্দর রাজধানীর হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর। নিরাপত্তার স্বার্থে কয়েক দফা তল্লাশির পরই এখানে একজন যাত্রী কোনো ফ্লাইটে উঠতে পারেন। এমনকি কোনো যাত্রীর সঙ্গে থাকা লাইটার, ছুরি, নেইলকাটার কিংবা লোহা সদৃশ কোনো বস্তু থাকলেও তা অত্যাধুনিক স্ক্যানার মেশিনে ধরা পড়ার কথা। আর এই পুরো তল্লাশির কাজটি করে থাকে এভসেক, যা পরিচালিত হয় বিমানবাহিনীর তত্ত্বাবধানে; কিন্তু এতসব নিরাপত্তার ভেতরেও গতকাল রবিবার শাহজালাল থেকে উড্ডয়নের কিছুক্ষণ পরই ছিনতাইচেষ্টার শিকার হয়েছিল বাংলাদেশ বিমানের ৭৩৭-৮০০ মডেলের উড়োজাহাজ ময়ূরপঙ্খি।যাত্রীদের মধ্যে থাকা এক যুবক অস্ত্র দেখিয়ে নিয়ন্ত্রণ নিতে চেষ্টা করেছিলেন ককপিটের; কিন্তু ক্রু এবং পাইলটদের তৎপরতায় বিমানটি চট্টগ্রাম শাহ আমানত বিমানবন্দরে জরুরি অবতরণ করে। সব যাত্রী নিরাপদে বেড়িয়ে আসতে সক্ষম হলেও ওই যুবক জিম্মি করে রাখে দুজনকে। তিন ঘণ্টার রুদ্ধশ্বাস চেষ্টার পর সেনা ও নৌ কমান্ডোদের যৌথ অভিযানে জিম্মি অবস্থার অবসান হয়। কমান্ডোদের সঙ্গে গোলাগুলিতে নিহত হয় ওই যুবক। বিমানটি ১৪২ যাত্রী ও ৫ ক্রুসহ ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম হয়ে দুবাই যাওয়ার কথা ছিল। মাত্র ৮ মিনিটের এই অভিযানে কমান্ডোদের সঙ্গে ছিল র্যাব ও পুলিশের বিশেষ স্কোয়াড সোয়াট; কিন্তু এই ছিনতাইচেষ্টার পর ঢাকার শাহজালাল বিমানবন্দরের নিরাপত্তাব্যবস্থা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, কয়েক দফা নিরাপত্তা তল্লাশি এড়িয়ে কীভাবে ওই যুবক অস্ত্র বা খেলনা অস্ত্র নিয়ে উড়োজাহাজে প্রবেশ করল তা এখনই খতিয়ে দেখা প্রয়োজন। নইলে ভবিষ্যতে তা দেশের বিমানবন্দরগুলোর নিরাপত্তা আরও ক্ষুণ্ন করতে পারে। প্রাথমিক তদন্তে জানা গেছে, নিহত ওই যুবকের নাম মাহেদী। তার বয়স আনুমানিক ২৬ থেকে ২৭ বছর। অভ্যন্তরণীণ ফ্লাইটের এই যাত্রীর টিকিটে নাম লেখা মো. মাজেদুল। এ ছাড়া তার আর বিস্তারিত পরিচয় পাওয়া যায়নি। কী উদ্দেশ্যে ওই যুবক বিমান ছিনতাইয়ের চেষ্টা করেছিলেন তাও সংশ্লিষ্টরা বলতে পারেননি। তার ব্যাপারে তদন্তে নেমেছে সরকারের একাধিক সংস্থা। তবে অভিযান শেষ হওয়ার পর শাহ আমানত বিমানবন্দরের ভিআইপি লাউঞ্জের সামনে সংবাদ ব্রিফিংয়ে চট্টগ্রাম সেনানিবাসের জিওসি মেজর জেনারেল এসএম মতিউর রহমান জানান, ওই তরুণ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও নিজের স্ত্রীর সঙ্গে কথা বলতে চেয়েছিলেন। জানা গেছে, ঘটনা তদন্তে এরইমধ্যে জব্দ করা হয়েছে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের সিসি ক্যামেরার ফুটেজ। বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয় সচিব মো. মহিবুল হক গতরাত ১২টায় জানান, ছিনতাইচেষ্টার ঘটনা তদন্তে ৫ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে, যার প্রধান করা হয়েছে তার মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মোকাব্বির হোসেনকে। প্রত্যক্ষদর্শী ও একাধিক যাত্রীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, গতকাল বিকাল সাড়ে ৪টার দিকে ঢাকার শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে ‘ময়ূরপঙ্খি’ উড়োজাহাজটি চট্টগ্রামের উদ্দেশে রওনা হয়। সেখান থেকে যাত্রী নিয়ে উড়োজাহাজটির দুবাই যাওয়া কথা ছিল। উড্ডয়নের পর বিকাল সাড়ে ৪টার দিকে ময়ূরপঙ্খি তখন প্রায় ১৫ হাজার ফুট ওপর দিয়ে উড়ে যাচ্ছিল। এ সময় যাত্রী আসনে থাকা ওই যুবক উঠে ককপিটের দিকে এসে এক ক্রুর কাছে যান। তাকে ধাক্কা দিয়ে পিস্তল ও বোমাসদৃশ একটি বস্তু বের করে বলেন, ‘আমি বিমানটি ছিনতাই করব। আমার কাছে পিস্তল ও বোমা আছে। ককপিট না খুললে আমি বিমান উড়িয়ে দেব।’ এর মধ্যে অন্য কেবিন ক্রুরা ককপিটে থাকা পাইলট ও সহকারী পাইলটকে গোপনে সাংকেতিক বার্তা দেন, উড়োজাহাজে অস্ত্রধারী আছে, উড়োজাহাজ ছিনতাইয়ের চেষ্টা হচ্ছে। ঠিক এ সময় উড়োজাহাজটি চট্টগ্রাম ও ঢাকার মাঝামাঝি জায়গায় অবস্থান করছিল। এটি অবতরণের আগে থেকেই নৌবাহিনীর সদস্যরা চট্টগ্রাম বিমানবন্দরের রানওয়েতে সতর্ক অবস্থান নেন। তখন চট্টগ্রাম বিমানবন্দরে সব ধরনের উড়োজাহাজের অবতরণ ও উড্ডয়ন বন্ধ রাখা হয়। এক পর্যায়ে নিরাপদেই ১৪২ যাত্রী নিয়ে ময়ূরপঙ্খি শাহ আমানত বিমানবন্দরে অবতরণ করে। এর আগেই সেনাবাহিনী, বিমানবাহিনী, পুলিশ, র্যাব ও বিজিবির সদস্যরা চট্টগ্রাম বিমানবন্দরের নিয়ন্ত্রণ নেন। যে কোনো পরস্থিতি মোকাবিলায় বিমানবন্দরের ভেতরে ও বাইরে ফায়ার সার্ভিসের সদস্যদের বাড়তি সতর্কাবস্থায় রাখা হয়। পরে কমান্ডো অভিযানে ছিনতাইকারী যুবক নিহত হলে সন্ধ্যা ৭টা ২৪ মিনিটে উড়োজাহাজটি মুক্ত হয়। প্রায় চার ঘণ্টা পর রাত ৯টার দিকে ফের শাহ আমানত বিমানবন্দর স্বাভাবিক হয়। ঘটনার সময় ৮ থেকে ১০টি ফ্লাইট ডিলে হয়েছে বলে জানা গেছে। কমান্ডো অভিযান শেষে সেনাবাহিনীর ২৪ পদাতিক ডিভিশনের জিওসি মেজর জেনারেল এসএম মতিউর রহমান প্রেস ব্রিফিংয়ে বলেন, ‘ঢাকা থেকে উড়োজাহাজটি আকাশে ওড়ার পরই হাতে থাকা পিস্তল দিয়ে ফাঁকা গুলি ছোড়েন যুবকটি। সেই সঙ্গে ককপিটে প্রবেশের চেষ্টা করেন; কিন্তু প্রবেশ করতে না পেরে চিৎকার করতে থাকেন। তিনি প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলারও দাবি জানান।’ এসএম মতিউর রহমান বলেন, ‘চট্টগ্রাম বিমানবন্দরে অবতরণের পর তাকে বারবার আত্মসমর্পণের আহ্বান জানানো হয়। তিনি তাতে অস্বীকার করে আসছিলেন। শেষ পর্যন্ত বিমানবাহিনীর কমান্ডো দলের সদস্যরা গুলি করে তাকে হত্যা করেন। এর আগে জরুরি অবতরণ দরজা দিয়ে যাত্রীদের নিরাপদে নামিয়ে আনা হয়।’ওই ঘটনায় আইএসপিআরের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, উদ্ভূত পরিস্থিতিতে সেনাবাহিনীর কাছে সহায়তা চাওয়া হলে সেনাবাহিনীর কমান্ডো দল ও ২৪ পদাতিক ডিভিশনের কুইক রিঅ্যাকশন ফোর্স (কিউআরএফ) প্লাটুন অতি দ্রুত চট্টগ্রাম বিমানবন্দরে পৌঁছে। উল্লেখ্য, সেনাবাহিনীর একটি কমান্ডো দল কুতুবদিয়ায় চলমান যৌথ অনুশীলনের জন্য চট্টগ্রামের নৌবাহিনী ঘাঁটি ঈশা খাঁয় ওই সময় অবস্থান করছিল। এমতাবস্থায় সেনাপ্রধানের নির্দেশক্রমে ও জিওসি ২৪ পদাতিক ডিভিশনের তত্ত্বাবধানে এবং লেফটেন্যান্ট কর্নেল ইমরুল, অধিনায়ক প্যারা কমান্ডো-১ ব্যাটালিয়নের নেতৃত্বে ছিনতাইকারীকে আটক করার জন্য আনুমানিক ৭টা ২০ মিনিটে অভিযান পরিচালনা করা হয়। প্রাথমিক অবস্থায় ছিনতাইকারীকে আত্মসমর্পণের আহ্বান করা হলেও সে আক্রমণাত্মক হয়ে ওঠে। এমতাবস্থায় ছিনতাইকারীকে নিবৃত করতে তাকে লক্ষ্য করে গুলি ছোড়া হয়। গুলিবিদ্ধ অবস্থায় ছিনতাইকারীকে বিমানের বাইরে নিয়ে আসা হলে কর্তব্যরত ডাক্তার তাকে মৃত ঘোষণা করেন। চার ধাপের নিরাপত্তা পার হয়ে উড়োজাহাজে ওঠে ছিনতাইকারী একাধিক সূত্রে জানা গেছে, কথিত মাহাদী নামে ওই যুবক শাহজালাল বিমানবন্দরে প্রবেশের পর রোডি কাউন্টার থেকে বোর্ডিং কার্ড নেন। এরপর ৩ নম্বর ইমিগ্রেশন কাউন্টার থেকে ইমিগ্রেশনের কাজ সম্পন্ন করেন। পরে ৪ নম্বর আইএমএস গেট দিয়ে বোর্ডিং ব্রিজ হয়ে ময়ূরপঙ্খি উড়োজাহাজে আরোহণ করেন। এর আগে বিমানবন্দরে প্রবেশের সময় আর্চওয়ে নিরাপত্তা গেট পার হন। সর্বশেষ ধাপ ছিল অ্যান্টি হাইজ্যাকিং পয়েন্ট। সেখানেও যাত্রীদের তল্লাশি করার কথা। ফলে এত নিরাপত্তা ধাপ পেরিয়ে কীভাবে সেই যুবক অস্ত্র নিয়ে উড়োজাহাজে উঠলেন তা নিয়ে এখন নানা প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।এ ব্যাপারে সিভিল এভিয়েশনের চেয়ারম্যান এয়ারভাইস মার্শাল এম নাঈম হাসান বলেন, শাহজালাল বিমানবন্দরের যে নিরাপত্তাব্যবস্থা তা ভেদ করে অস্ত্র নিয়ে ভেতরে প্রবেশ করা সম্ভব নয়। তদন্তের পর এ ব্যাপারে বিস্তারিত জানা যাবে। কারও কোনো গাফিলতি থাকলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এয়ার ভাইস মার্শাল এম নাইম হাসান আরও বলেন, বিমানের মধ্যে যারা অস্ত্রধারীর (ছিনতাইয়ের চেষ্টাকারী) সঙ্গে কথা বলেছেন, তারা বলেছেন, ওই ব্যক্তিকে তাদের কিছুটা মানসিক ভারসাম্যহীন মনে হয়েছে। জঙ্গি বা সন্ত্রাসী উদ্দেশ্য ছাড়া কেউ এমন ঘটনা ঘটাতে পারে কিনা, এ প্রশ্নের উত্তরে এয়ার ভাইস মার্শাল এম নাইম হাসান বলেন, এখনই এ ব্যাপারে আমি মন্তব্য করতে চাচ্ছি না। ছিনতাইয়ের কারণ সম্পর্কে বলতে গিয়ে এম নাইম হাসান বলেন, দেশের ইকোনমিক অবস্থা অত্যন্ত ভালো হয়েছে। মানুষ প্লেনে যাওয়া শুরু করেছে, তাদের ইকোনমির এফোর্ট বেড়েছে। এই অগ্রযাত্রা অনেকের হিংসার কারণ হতেও পারে। এসব অগ্রযাত্রা অনেকে লাইক না-ও করতে পারে। এদিকে গতরাত ১টায় চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশ কমিশনার মাহবুবর রহমান আমাদের সময়কে বলেন, কমান্ডো অভিযানে যে যুবক নিহত হয়েছেন, তার হাতে থাকা অস্ত্রটি ছিল খেলনা পিস্তল। আর তার শরীরে তেমন কিছু প্যাঁচানো ছিল না। যুবকের বিস্তারিত পরিচয় জানার চেষ্টা চলছে বলেও জানান তিনি।
যুক্তরাজ্যের নিরাপত্তা সতর্কতা জারি
বাংলাদেশে বিমান ছিনতাইচেষ্টার ঘটনায় এখানে থাকা নাগরিকদের সতর্ক করছে ব্রিটিশ সরকার। গতকাল দেশটির সরকারের জারি করা নিরাপত্তা সতর্কতায় বলা হয়েছে, চট্টগ্রাম বিমানবন্দরে নিরাপত্তা সংক্রান্ত ঘটনার প্রেক্ষাপটে এ সতর্কতা জারি করা হলো। বার্তায় আরও বলা হয়, ছিনতাইচেষ্টার ঘটনায় শাহ আমানত বিমানবন্দর বন্ধ রয়েছে। এতে যাত্রীদের ভ্রমণে বিঘ্ন ঘটতে পারে। ফলে ব্রিটিশ নাগরিকদের বিমানবন্দর পরিস্থিতির তথ্য হালনাগাদ থাকা উচিত।