পুরান ঢাকার চুড়িহাট্টায় ভয়াবহ অগ্নিকা-ে ঝরে গেছে ৬৭ প্রাণ। আহত হয়েছেন অর্ধশতাধিক। এদের মধ্যে গুরুতর ১১ জনের অবস্থার কোনো পরিবর্তন হয়নি। গত বুধবার রাতের এই অগ্নিকা-ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে চুড়িহাট্টা চৌরাস্তার ওয়াহেদ ম্যানশনসহ আশপাশের পাঁচটি ভবন। এর মধ্যে তিনটিকে ঝুঁকিপূর্ণ বলছে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। খবর পেয়েই সেদিন যদি ফায়ার সার্ভিস, র্যাব-পুলিশ, রেড ক্রিসেন্টের সদস্য ও স্থানীয়রা আগুন নেভানো ও উদ্ধারকাজে ঝাঁপিয়ে না পড়ত, তা হলে এ ঘটনায় হতাহতের সংখ্যা আরও বাড়ত বলে স্থানীয়দের অভিমত। যদিও উদ্ধারের নামে সে রাতে সক্রিয় হয়ে উঠেছিল দুর্বৃত্তরা। ক্ষতিগ্রস্ত ভবনের যেসব ফ্ল্যাট আগুনের লেলিহান শিখা থেকে রক্ষা পেয়েছে তার অধিকাংশ কক্ষেই তারা লুটপাট চালিয়েছে। চারদিকে আহত মানুষের চিৎকার, ব্যবসায়ীদের হাহাকারেও মন গলেনি তাদের। সুযোগ বুঝে আগুন থেকে বাঁচতে ঘরছাড়া ফ্ল্যাটবাসীর আলমারিতে রাখা স্বর্ণালঙ্কারসহ লাখ লাখ টাকা নিয়ে সটকে পড়েছে। গতকাল সোমবার চুড়িহাট্টা এলাকা ঘুরে ভুক্তভোগীদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে। বুধবার রাতে চকবাজারের চুড়িহাট্টার ৬৪ নম্বর হাজি ওয়াহেদ ম্যানশনে আগুনের তা-ব ছিল সর্বাধিক। এর ঠিক পাশের ৬ তলা ভবনটিই মো. বাবুলের। ভবনটির ৬ষ্ঠ তলায় তিনি সপরিবারে বাস করেন। সে রাতে ওয়াহেদ ম্যানশনের আগুন অন্য চারটি ভবনের মতো বাবুলের ভবনে এসেও লাগে। গতকাল দুপুরে ওয়াহেদ ম্যানশনের পেছনের গলিতে একটি প্লাস্টিকের চেয়ারে মাথায় হাত দিয়ে বসেছিলেন বাবুলের স্ত্রী সাহিদা বেগম। তিনি জানান, ঘটনার সময় তারা ঘরেই ছিলেন। হঠাৎ বিকট শব্দে তারা ভাবেন, কোনো গাড়ির টায়ার ফেটেছে। কিন্তু একটু পরই তাদের ভুল ভাঙে। আগুন আগুন চিৎকারে স্থানীয়দের পালাতে দেখে ঘর খোলা রেখেই বেরিয়ে পড়েন তারা। সাহিদা বেগম বলেন, ভবনের ৬ তলার একটি ফ্লাটের শেষ কক্ষে আমরা স্বামী-স্ত্রী থাকতাম। কক্ষটিতে আগুনের আঁচ লাগলেও কিছুই পোড়েনি। ফায়ার সার্ভিসের লোকজন আগুন নেভানোর পর বাসায় এসে দেখি, আলমারির দরজা ভাঙা। নিচে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে কয়েকটি ব্যাগ। আলমারির বিভিন্ন স্থানে এসব ব্যাগে ৪ লাখ টাকা রাখা ছিল। দুটি ছোট ব্যাগে ছিল সোনা-রুপার ৪০ ভরি স্বর্ণালঙ্কার। কিন্তু কিছু নেই। এই বাড়িতে আত্মীয়স্বজন মিলে ৪০ জনের মতো বাস করতাম। এখন সবাই রাস্তায় নেমে এসেছি। থাকছি আত্মীয়ের বাড়িতে। আগুন আমাদের নিঃস্ব করে দিয়েছে। সাহিদা বেগমের মতো লুটপাটের শিকার আরও দুজন একই অভিযোগ তোলেন। অগ্নিকা-ের ঘটনার পর থেকেই আলোচনায় ওয়াহেদ ম্যানশন। কেবল ভবনই নয়, এতে মজুদ থাকা রাসায়নিকের গুদামও এখন আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে। রাসায়নিকের কারণেই আগুনের সূত্রপাত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তা রাস্তায় থাকা মানুষ ও যানবাহনসহ আশপাশের ভবনগুলোয় ছড়িয়ে পড়ে। কিন্তু ঘটনার পাঁচদিন পরও অবৈধভাবে রাসায়নিকের মজুদকারী ওয়াহেদ ম্যানশনের দুই মালিক মো. হাসান ও সোহেল ওরফে শহীদকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। চকবাজার থানায় করা একটি মামলার আসামি হাসান ও সোহেল। মামলার বাদী স্থানীয় বাসিন্দা মো. আসিফ। তার বাবা জুম্মন অগ্নিকা-ে প্রাণ হারিয়েছেন। মামলার এজাহারে ১০-১২ জন অজ্ঞাত আসামিসহ আরও উল্লেখ করা হয়েছে, ওয়াহেদ ম্যানশনের বিভিন্ন তলায় দাহ্যপদার্থের গুদাম ভাড়া দেওয়ায় তাদের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে। তাদের অবৈধ গুদামের কারণে আগুনের ভয়াবহতা বেড়েছিল। অগ্নিকা-ের ঘটনায় চকবাজার থানায় করা মামলার তদন্ত করছেন পরিদর্শক মুরাদুল ইসলাম। তিনি জানান, এজাহারভুক্ত দুজনকে (হাসান ও সোহেল) এখনো গ্রেপ্তার করা সম্ভব হয়নি। যে কারণে অন্য আসামিদেরও ধরা সম্ভব হচ্ছে না। আসামিদের ধরতে চেষ্টা করা হচ্ছে। তাদের মোবাইল ফোনের কল ডিটেইলড রেকর্ড (সিডিআর) বের করা হয়েছে। সেটা ধরে অবস্থান নিশ্চিত হয়ে তাদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। চকবাজার থানায় গতকাল গিয়ে দেখা গেছে, পুলিশের একাধিক টিম চকবাজার থেকে উদ্ধার করা বস্তাভর্তি আলামত সংগ্রহের তালিকা যাচাই-বাছাই করছে। পুলিশ জানায়, আগুনের ঘটনায় ওয়াসা, সিটি করপোরেশন, রাজউক, বিস্ফোরক অধিদপ্তরসহ সংশ্লিষ্ট সেবা প্রতিষ্ঠানগুলোর দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের যেসব গাফিলতি ছিল, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। ইতোমধ্যে স্থানীয় ২০ থেকে ৩০ জনকে অনানুষ্ঠানিকভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। সব তথ্যউপাত্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হবে। লুটপাটের কোনো অভিযোগ এখনো কেউ জানায়নি। অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। এদিকে পুরান ঢাকার ঝুঁকিপূর্ণ কেমিক্যাল কারখানা ও গোডাউন অপসারণের জন্য দুটি টাস্কফোর্স গঠন করা হবে বলে জানিয়েছেন ডিএসসিসি মেয়র মোহাম্মদ সাঈদ খোকন। আগামী ২৮ ফেব্রুয়ারি এ টাস্কফোর্স অনগ্রাউন্ডে কাজ শুরু করবে। গতকাল পুরান ঢাকার কেমিক্যাল কারখানা ও গোডাউন বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ বাস্তবায়ন করতে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোকে নিয়ে অনুষ্ঠিত এক বিশেষ জরুরি সভায় তিনি এ কথা জানান। সাঈদ খোকন বলেন, পুরান ঢাকার কেমিক্যাল কারখানা অপসারণের জন্য দুই স্তরবিশিষ্ট দুটি টাস্কফোর্স গঠনের সিদ্ধান্ত হয়েছে। প্রথম স্তরে থাকবে সংস্থার প্রধানসহ ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ। যে কমিটি সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় এনে করণীয় এবং এর বাস্তবায়নের অগ্রগতি পর্যালোচনা করে সময়মতো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে। পাশাপাশি বাস্তবায়নের বিষয়ে কাজ করবে। আর দ্বিতীয় কমিটি অনগ্রাউন্ডে থাকবে। ইতোমধ্যে ১৫টি ওয়ার্ড ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এর মধ্য থেকে দুই-তিনটি ওয়ার্ড সমন্বয় করে এ কমিটি কাজ করবে। টাস্কফোর্সে যেসব ম্যাজিস্ট্রেট থাকবেন, তারা আইনগতভাবে কাজ শুরু করবেন। আগামী এক মাসের মধ্যে পুরান ঢাকার আবাসিক এলাকা থেকে সব কেমিক্যাল গোডাউন অপসারণ করার কথা জানিয়ে মেয়র সাঈদ খোকন বলেন, যেসব বাসা বা ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানে ক্ষতিকর কেমিক্যাল জাতীয় দব্য পাওয়া যাবে সেখানে বিদ্যুৎ, গ্যাস ও পানির সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হবে। ২৮ ফেব্রুয়ারি থেকে ১ এপ্রিলের মধ্যে পুরান ঢাকা থেকে সব কেমিক্যাল বা ক্ষতিকর দ্রব্যের কারখানা অপসারণ করা হবে বলেও জানান তিনি। এদিকে স্থানীয় কর্তৃপক্ষের অনুমোদন ছাড়া কোনো দাহ্য রাসায়নিক পণ্যের ব্যবসায়িক ব্যাংকিং সুবিধা প্রদান না করতে সুপারিশ করেছে শিল্প মন্ত্রণালয়। গতকাল অগ্নিকা-ের ঘটনা পরবর্তী করণীয় নির্ধারণে শিল্প মন্ত্রণালয়ে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, সংস্থা ও ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বৈঠকে এ সুপারিশ করা হয়। সভায় পুলিশের মহাপরিদর্শক আইজিপি মোহাম্মদ জাবেদ পাটোয়ারী, ডিএমপি কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া, ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের মহাপরিচালক (ডিজি) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আলী আহাম্মেদ খান, রাজউকের চেয়ারম্যান প্রকৌশলী আবদুর রহমান, ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক তাসকিন এ খান, স্থানীয় সংসদ সদস্য হাজী সেলিমসহ অন্যরা উপস্থিত ছিলেন। আসামি হাসান ও সোহেলসহ অবৈধভাবে রাসায়নিক ব্যবসায়ীদের গ্রেপ্তার, পুরান ঢাকা থেকে রাসায়নিকের মজুদ অপসারণ এবং হতাহতদের ক্ষতিপূরণের দাবিতে গতকাল চুড়িহাট্টাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে বিক্ষোভ ও মানববন্ধন করা হয়েছে। গতকাল জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে আয়োজিত মানববন্ধন ও বিক্ষোভ মিছিল থেকে অগ্নিকা-ে নিহতদের এক কোটি এবং আহতদের ৫০ লাখ টাকা করে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার দাবি জানায় গণতান্ত্রিক বাম ঐক্য। বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী) সিপিবি (এম) সাধারণ সম্পাদক ও গণতান্ত্রিক বাম ঐক্যের সমন্বয়ক ডাক্তার এম এ সামাদ বলেন, এর দায় সরকারসহ সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়কে নিতে হবে। অবিলম্বে বিচার বিভাগীয় তদন্তের মাধ্যমে দায়ী ব্যক্তিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি এবং আবাসিক এলাকা থেকে রাসায়নিক গোডাউন সরিয়ে নেওয়ারও দাবি জানান তিনি।
সর্বশেষ
সুনামগঞ্জে বিদ্যুৎস্পৃষ্টে যুবকের মৃত্যু
দর্পন টিভি - 0
সুনামগঞ্জের শাল্লায় বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে এক যুবকের মৃত্যু হয়েছে।
মঙ্গলবার (১৫ নভেম্বর) সকালে উপজেলার জনস্বাস্থ্যের নির্মাণাধীন ভবনের দ্বিতীয় তলার ছাদে...