রাজধানীর বনেদি বা অভিজাতপাড়া বলে খ্যাত গুলশান-বনানী। আবাসিক এ এলাকায় কেবল মানুষ বসবাসের কথা থাকলেও পুরান ঢাকার মতোই ঝুঁকিপূর্ণ কেমিক্যাল গোডাউনে ঠাসা। পার্শ্ববর্তী তেজগাঁও শিল্প এলাকাতে শিল্প-কারখানা স্থাপনের জন্য সরকারি বরাদ্দকৃত প্লটকেও বানানো হয়েছে বিভিন্ন রাসায়নিক রাখার গুদাম। আর পুরো রাজধানীতেই ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে এমন ৯৪৪টি গোডাউন। এর মধ্যে ফায়ার সার্ভিস, বিস্ফোরক অধিদপ্তরসহ সংশ্লিষ্টদের অনুমোদন রয়েছে কেবল ৭৭টির। বাকি ৮৬৭ দাহ্য পদার্থ মজুতের স্থানই অবৈধ। জানা গেছে, অবৈধ রাসায়নিক মজুতের বিরুদ্ধে সরকারি বিভিন্ন সংস্থাকে নিয়ে ২০১৬ সালের মার্চে একটি টাস্কফোর্স গঠিত হয়। এতে রয়েছে ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্স, বিস্ফোরক অধিদপ্তর, পরিবেশ অধিদপ্তর, দুর্যোগ মন্ত্রণালয়, ঢাকা মহানগর পুলিশ, সিটি করপোরেশনসহ সংশ্লিষ্ট সংস্থা। অবৈধভাবে স্থাপিত গুদাম উচ্ছেদসহ আইন ভেঙে বিপজ্জনক ব্যবসা পরিচালনাকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ারও ক্ষমতা ছিল তাদের। কিন্তু টাস্কফোর্সের সে কাজ তো দূরের কথা, রাসায়নিক গুদাম পরিচালনায় ১২৩টি প্রতিষ্ঠান তাদের লাইসেন্স নবায়ন করে ব্যবসা চালিয়ে গেলেও কিছু করতে পারেনি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, টাস্কফোর্সের হাতে এসব অবৈধ গুদামের তালিকা থাকা সত্ত্বেও নিয়মিত অভিযান পরিচালনা না করায় প্রতিষ্ঠানগুলোর মালিকরা এ সাহস পেয়েছেন। আবার কোনো কোনো সংস্থার কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে, অবৈধ ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে মাসোহারা নিয়ে এসব গুদাম পরিচালনার সুযোগ দিয়েছেন। ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্স সূত্র জানায়, রাজধানীতে স্থাপিত ৮৬৭টি অবৈধ কেমিক্যাল গুদামের মধ্যে সবচেয়ে বেশি, ৩৭১টির অবস্থান পুরান ঢাকার সূত্রাপুর ও কোতোয়ালি থানা এলাকায়। আর তেজগাঁও-গুলশান-বনানী এলাকায় রয়েছে ৬৮টি, কামরাঙ্গীরচরে ৮৭টি, রমনা থানা এলাকায় ৬৬টি। এর বাইরে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক অনুমোদনহীন কেমিক্যাল গুদাম রয়েছে লালবাগ, ওয়ারী, চকবাজার, হাজারীবাগ, মোহাম্মদপুরের জাফরাবাদ, গে-ারিয়া, যাত্রাবাড়ী, কদমতলী এলাকায়। টাস্কফোর্স সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা জানান, ২০১০ সালের ৩ জুন নিমতলীর অগ্নিকা-ে ১২৪ জন নিহত হওয়ার পর প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে টাস্কফোর্স গঠন হয়। রাসায়নিক ব্যবসায়ীদের সাজা প্রদান নয়, কেরানীগঞ্জে বিসিকের প্লটে গুদাম স্থানান্তর করে বসবাসের নগরীকে আগুনের ঝুঁকি থেকে মুক্ত করাই ছিল এর উদ্দেশ্য। সেই সঙ্গে হাজারীবাগের ট্যানারি শিল্পের মতো রাসায়নিকের গুদাম স্থানান্তরের সময়সীমা বেঁধে দেওয়ার পরও যারা নতুন ঠিকানায় যাবে না, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া। কিন্তু ব্যবসায়ীদের বিষয়ে শিল্প মন্ত্রণালয়ের নরম সুরে শেষ পর্যন্ত বিসিকের প্লটে গুদাম স্থানান্তরের প্রক্রিয়া ভেস্তে যায়। এতে টাস্কফোর্সের কার্যকারিতা হারানো এমনকি ধারাবাহিকতা রক্ষায় পরবর্তীতে কোনো সভাও হয়নি। আর এ সুযোগে লাইসেন্সপ্রাপ্ত ১২৩টি গুদাম মালিকও তা নবায়ন করেননি। তবে টাস্কফোর্সের সদস্য সংস্থাগুলোর প্রত্যেকের হাতেই অভিযান চালিয়ে অবৈধ গুদাম মালিকের বিরুদ্ধে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করে প্রতিষ্ঠান সিলগালা ও সাজার সুযোগ রয়েছে। এ নিয়ে দুয়েকটি অভিযান পরিচালনা হলেও শেষ পর্যন্ত ব্যবসায়ীদের তোপের মুখে সিটি করপোরেশন পিছু হটে। পরে সিটি করপোরেশনের স্থানীয় কাউন্সিলরদের নেতৃত্বে স্ব স্ব এলাকার অবৈধ গুদাম উচ্ছেদ বা লাইসেন্স প্রাপ্তির সুযোগ দেওয়া হয়। তাতেও কাজের কাজ হয়নি। আর সে কারণেই নিমতলীর মতো চুড়িহাট্টায় এত বড় বিপর্যয়ের পুনরাবৃত্তি হলো। ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আলী আহাম্মেদ খান আমাদের সময়কে বলেন, ‘অবৈধ রাসায়নিকের গুদাম আমরা চিহ্নিত করে দিলেও এককভাবে অভিযান পরিচালনা করার মতো ফোর্স নেই। তাই টাস্কফোর্সের অধীনে যে অভিযান পরিচালনা হয় সেটা মেয়রের নেতৃত্বেই। উনি (মেয়র) একবার অভিযান পরিচালনার চেষ্টাও করেছিলেন। হয়তো চাপের মুখে তা বন্ধ হয়ে যায়। পরে স্থানীয় কাউন্সিলরদের অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এর পর কিছু কিছু গুদাম সরিয়ে ফেলার পর আবারও একই জায়গায় নিয়ে আসা হয়।’ এ ক্ষেত্রে দুর্বল মনিটরিং ব্যবস্থার কথা স্বীকার করেন তিনি। ভোক্তা অধিকারের সংগঠন কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) প্রেসিডেন্ট ও সাবেক প্রধান তথ্য কমিশনার ড. গোলাম রহমান বলেন, ‘পুরান ঢাকা কী, পুরো ঢাকার কোথায় কোথায় অবৈধ রাসায়নিকের গুদাম বা কারখানা আছে সবই প্রশাসনের জানা। তারা ব্যবস্থা না নেওয়ার কারণেই এতগুলো প্রাণহানি।’ তিনি বলেন, ‘রাজধানীতে অপরিকল্পিত বা অবৈধ কেমিক্যাল গুদামের কারণেই কেউ ঝুঁকির বাইরে নন। এ জন্য একে অপরের ওপর দায় না চাপিয়ে এখনই সময়, ঝুঁকিপূর্ণ গুদাম বা কারখানাগুলো বাইরের নিরাপদ স্থানে স্থানান্তর করা।’ একই সঙ্গে গণমানুষের নিরাপত্তার তাগিদে রাজধানীতে থাকা বৈধ কারখানা বা গুদামের লাইসেন্স বাতিলেরও যৌক্তিকতা দেখান তিনি। এ দিকে চকবাজারের চুড়িহাট্টা অগ্নিকা-ের ঘটনায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় গঠিত পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি গতকাল পর্যন্ত ১৬১ ধারায় অগ্নিদগ্ধ, পা ভেঙে আহত, প্রত্যক্ষদর্শী, ব্যবসায়ী, ওই ঘটনায় অগ্নি নির্বাপণকারী ফায়ার সার্ভিসের একাধিক কর্মকর্তার সাক্ষ্য নিয়েছে। ফায়ার সার্ভিসের অনুসন্ধানী দলের প্রতিবেদন ও সাক্ষীদের তথ্য সমন্বয় করেই এ কমিটি অগ্নিকাণ্ডের সূত্রপাতসহ পুরো ঘটনা নিয়ে প্রতিবেদন দাখিল করবে। জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (অগ্নি শাখা) প্রদীপ রঞ্জন চক্রবর্তী বলেন, ‘সুষ্ঠু তদন্ত ও প্রকৃত ঘটনা উপস্থাপনের স্বার্থে আমরা আলাদা আলাদাভাবে প্রত্যেকের সাক্ষ্যগ্রহণ করছি। আবার একেকজন কর্মকর্তাকে আলাদা করে একেক ব্যক্তির সাক্ষ্যগ্রহণের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। সব পক্ষের সাক্ষ্য এবং টেকনিক্যাল দলের নিজস্ব অনুসন্ধান সমন্বয় করেই আমরা প্রকৃত সত্যটা উপস্থাপন করতে পারব বলে আশা করছি।’
সর্বশেষ
সুনামগঞ্জে বিদ্যুৎস্পৃষ্টে যুবকের মৃত্যু
দর্পন টিভি - 0
সুনামগঞ্জের শাল্লায় বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে এক যুবকের মৃত্যু হয়েছে।
মঙ্গলবার (১৫ নভেম্বর) সকালে উপজেলার জনস্বাস্থ্যের নির্মাণাধীন ভবনের দ্বিতীয় তলার ছাদে...