বিএনপিতে হতাশার সঙ্গে ক্ষোভ বাড়ছে

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ফল বিপর্যয়ের কারণে হতাশার সঙ্গে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের কথা ভেবে নতুন করে বিএনপিতে ক্ষোভও বাড়ছে। এ অবস্থা দলটির স্থায়ী কমিটি থেকে শুরু করে তৃণমূল সর্বত্রই বিরাজমান। দলের আনুষ্ঠানিক-অনানুষ্ঠানিক বৈঠকগুলোয় কোনো কোনো নেতা ক্ষোভও প্রকাশ করছেন। অনেক সিনিয়র নেতা রাজনীতি থেকে নিষ্ক্রিয় হওয়ার কথাও ভাবছেন। এ অবস্থায় দলটির নীতিনির্ধারণী ফোরাম জাতীয় স্থায়ী কমিটির নেতারা দল পরিচালনায় একটি গাইডলাইন প্রস্তুত করার উদ্যোগ নিয়েছেন। চূড়ান্ত হলে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে দেওয়া হবে বলে বিএনপির নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে। জানতে চাইলে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের ট্রাস্টি ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী আমাদের সময়কে বলেন, বিএনপিতে ক্ষোভ বাড়া তো স্বাভাবিক। তাদের নেতারা তো আত্মহননের পথ বেছে নিয়েছে। খালেদা জিয়া কারাবন্দি হওয়ার পর এক সংবাদ সম্মেলন ও প্রেসক্লাবের সামনে কয়েক কর্মসূচি করা ছাড়া আর কোনো কর্মসূচিই করেনি। এ অবস্থায় দলটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানকেও কৌশল পাল্টাতে হবে। খালেদা জিয়াকে মুক্ত করতে আন্দোলনের কোনো বিকল্প নেই। চলমান পরিস্থিতিতে চলতি সপ্তাহে যুক্তরাজ্যে অবস্থানরত তারেক রহমানও তৃণমূলের নেতাদের মতামত জানতে ৮১ সাংগঠনিক জেলার নেতাদের ঢাকায় ডেকেছেন। পর্যায়ক্রমে স্কাইপিতে সংশ্লিষ্ট জেলার বিভিন্ন ইউনিটের সাংগঠনিক অবস্থাসহ এলাকার প্রকৃত চিত্র ও করণীয় কী হতে পারে এ সম্পর্কে জানতে চাইবেন। সংশ্লিষ্ট বিভাগের সাংগঠনিক সম্পাদক ও সহম্পাদকদের উপস্থিতিতে তারেক রহমান জেলার নেতাদের সঙ্গে কথা বলবেন বলে আমাদের সময়কে নিশ্চিত করেছেন দুই সহসাংগঠনিক সম্পাদক।

দলের স্থায়ী কমিটির দুই সদস্য ও এক ভাইস চেয়ারম্যান যোগাযোগ করলে তারা বলেন, চলমান সংকটময় পরিস্থিতিতে খালেদা জিয়াকেই সামনে আনতে হবে। দলের সব পর্যায়ের নেতাকর্মী তার নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ। তাই তাকে মুক্ত করতে আন্দোলনের কোনো বিকল্প নেই। এ কর্মসূচি বিএনপিকেই দিতে হবে। এখন যত কর্মসূচি দেওয়া হয়, সেখানে হয় জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট অথবা ২০-দলীয় জোটের ব্যানারে। সম্প্রতি জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের গণশুনানিতেও বেশ কয়েকজন ধানের শীষের প্রার্থীও খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবিতে কর্মসূচি দাবি করেছেন। দলটির একাধিক নেতা বলেন, জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় আদালতের রায়ে গত বছরের ৮ ফেব্রুয়ারি থেকে চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া কারাবন্দি আছেন। তার অবর্তমানে যুক্তরাজ্যে অবস্থানরত বিএনপির গঠনতন্ত্র অনুযায়ী দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হন তারেক রহমান। তখন থেকেই তারেক রহমান ও স্থায়ী কমিটির নেতাদের সমন্বয়ে যৌথ নেতৃত্বে দল পরিচালিত হয়ে আসছিল। কিন্তু গত ৩০ ডিসেম্বর একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ফল বিপর্যয়ের পর ‘যৌথ নেতৃত্ব’ দৃশ্যমান দেখা মিলছে না। স্থায়ী কমিটির কিছু নেতাসহ তৃণমূল পর্যায়ের নেতাকর্মীরাও নিজেদের মধ্যে বলতে শুরু করেছে খালেদা জিয়াকে মুক্ত না করে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নেওয়া সঠিক সিদ্ধান্ত হয়নি। এ জন্য দলের গুরুত্বপূর্ণ নেতাদেরও তারা দায়ী করতেও ছাড়ছেন না। সম্প্রতি নির্বাচনের পর যশোর সদর উপজেলার কচুয়া ইউনিয়নে হামলার শিকার নেতাকর্মীদের বাড়িঘর পরিদর্শনে গেলে সেখানে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান মো. শাজাহানের নেতৃত্বে যাওয়া প্রতিনিধি দলটি স্থানীয় নেতাকর্মীদের তোপের মুখে পড়ে। নেতাকর্মীরা প্রশ্ন করেন ‘খালেদা জিয়া কবে মুক্তি পাবেন, কী করছেন আপনারা, আন্দোলনে যাচ্ছেন না কেন? না খেয়ে পালিয়ে থাকতে থাকতে তো এমনিতেই মরতে বসেছি। আন্দোলনের ডাক দেন, রাস্তায় গিয়ে মরি। আন্দোলনে আমরা তো ব্যর্থ হইনি, আপনারা (কেন্দ্রীয় নেতাদের উদ্দেশ করে) ব্যর্থ হয়েছেন’। একই ধরনের ক্ষোভের মুখে রাজধানী ঢাকার কর্মসূচিতেও বিএনপির সিনিয়র নেতাদের পড়তে হয়েছে। গত ২০ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের বক্তব্য চলাকালে তখন নেতাকর্মীরা বলে ওঠেন কর্মসূচি দেন। পরে মির্জা ফখরুল ইসলাম নেতাকর্মীদের বলেন ‘দাঁড়ান, দাঁড়ান। চাইলেই কর্মসূচি দেওয়া যায় না। কর্মসূচি পালন করতে হবে।’ নেতাকর্মীরা তখন বলেন, ‘হয়তো কর্মসূচি দেন, না হয় বিএনপি ভেঙে দেন।’ নেতাকর্মীদের উদ্দেশে মির্জা ফখরুল বলেন, ‘আপনাদের যে ক্ষোভ ও ব্যথা, এটি আমরা বুঝি। একই অনুষ্ঠানে স্থায়ী কমিটির সদস্য মওদুদ আহমদও নেতাকর্মীদের ক্ষোভের কবলে পড়েন। তৃণমূলের এই ক্ষোভের মাঝে দল পুনর্গঠন কাজ শুরু করেছে বিএনপি। দলটির ১১টি অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের মধ্যে জাতীয়তাবাদী মৎস্যজীবী দল এবং কৃষক দলের নতুন আহ্বায়ক কমিটি ঘোষণা করা হয়েছে। এ ছাড়া ড্যাব, এ্যাব ও বিএনপির বিদেশবিষয়ক উপকমিটি পুনর্গঠন করা হয়েছে। নির্বাচনপরবর্তী সময়ে হামলা মামলা ও গ্রেপ্তার তৃণমূলের নেতাকর্মীদের খোঁজখবর নিতে একাধিক কমিটি গঠন করা হয়েছে। জানা গেছে, এ কমিটি গঠন বিষয়ে দলটির স্থায়ী কমিটি অবগত ছিল না। এসব ঘটনায় স্থায়ী কমিটির নেতারা নিজেদের উপেক্ষিত মনে করছেন। সিনিয়র এসব নেতা মনে করেন, দলের কোনো পর্যায় থেকে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে ভুল বোঝানো হচ্ছে। যার কারণে উল্লিখিত কমিটিগুলোতে যোগ্য নেতৃত্ব না এসে ব্যক্তিবিশেষের কমিটি হয়েছে। এটি আর হতে দেওয়া যায় না। এমনটি চলতে থাকলে তারেক রহমানের নেতৃত্ব নিয়েই প্রশ্ন উঠবে। স্থায়ী কমিটির নেতারা এ চিন্তা থেকে দল পরিচালনায় তারেক রহমানকে সহযোগিতা করতে একটি গাইডলাইন প্রস্তুত করার উদ্যোগ নিয়েছে। গত সপ্তাহে একটি বৈঠকও হয়েছে। চলতি সপ্তাহে আরও একটি বৈঠক হতে পারে। বিএনপির কেন্দ্রীয় একাধিক নেতা জানান, ঢাকা থেকে বিভিন্ন মাধ্যমে তারেক রহমানের সঙ্গে অনেক নেতারই কথা হয়। তাদের একটি অংশ নিজেদের তারেক রহমানের বিশেষ লোক দাবি করে নানাভাবে দলের মধ্যে প্রভাব বিস্তার করছে। বাস্তবিক অর্থে এসব চিহ্নিত নেতাকর্মীদের কাছে অপছন্দের। নেতারা মনে করেন, এ মুহূর্তে বেগম খালেদা জিয়াকে আন্দোলনের মাধ্যমে মুক্ত করা না গেলে দলের মধ্যে নেতাদের প্রতি কর্মীদের ক্ষোভ আরও বাড়তে থাকবে।