ছাত্রলীগের প্রতিদ্বন্দ্বী ছাত্রলীগ

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি) ক্যাম্পাসে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের ভাতৃপ্রতিম ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগের একক আধিপত্য অনেকদিন ধরেই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (ডাকসু) আসন্ন নির্বাচনকে কেন্দ্র করে প্রার্থী মনোনয়নে এতদিন অনেকটাই নির্ভার দেখা গেছে এ সংগঠনটিকে। কিন্তু নির্বাচনের দিন যত ঘনিয়ে আসছে, ততই স্পষ্ট হয়ে উঠছে সংগঠনের নেতাদের মধ্যে বিভেদ; ক্রমেই ভারি হচ্ছে ‘একলা চলো নীতি’। দীর্ঘদিনের জোট ছাত্রসংগ্রাম পরিষদভুক্ত সংগঠনগুলো ১১ মার্চ অনুষ্ঠেয় ডাকসু নির্বাচনে পৃথক প্যানেল দিয়েছে। আর ছাত্রলীগ পূর্ণাঙ্গ প্যানেল দিলেও শুরুর দিকেই বিদ্রোহ করে পৃথক প্যানেলের ঘোষণা দেন সংগঠনটির প্যানেলবঞ্চিত নেতারা। আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতাদের মধ্যে ডাকসু নির্বাচন বিষয়ে যাদের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে, তাদের হস্তক্ষেপে এ বিদ্রোহ আপাত মিটে গেলেও হল সংসদগুলোতে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে লড়াইয়ে শামিল হচ্ছেন ছাত্রলীগের বঞ্চিত নেতারা। সংগঠনটির প্রার্থীদের প্রচারকাজও চলছে অনেকটাই অগোছালোভাবে।ডাকসু নির্বাচনে সহসভাপতি (ভিপি) পদে ছাত্রলীগের প্যানেল থেকে নির্বাচন করছেন সংগঠনটির কেন্দ্রীয় সভাপতি রেজওয়ানুল হক চৌধুরী শোভন, সাধারণ সম্পাদক (জিএস) পদে কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক গোলাম রাব্বানী এবং সহ-সাধারণ সম্পাদক (এজিএস) পদে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সাধারণ সম্পাদক সাদ্দাম হোসাইন। প্যানেল ঘোষণার পর থেকেই এর বিরোধিতা করে বঞ্চিতদের একাংশ। তারা পৃথক প্যানেলের ঘোষণা দেন। তবে আওয়ামী লীগের শীর্ষস্থানীয় একাধিক নেতার হস্তক্ষেপে সে বিদ্রোহ সামাল দেওয়া গেলেও হল সংসদ নির্বাচনে বিদ্রোহীদের অনেকেই স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনী লড়াইয়ে নেমেছেন। বিদ্রোহীদের প্রার্থিতা প্রত্যাহারে বিভিন্ন রকম হুমকি-ধমকি দেওয়া হচ্ছে বলে গত কয়েকদিন অভিযোগও পাওয়া গেছে। গতকাল শনিবার দুপুরে মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের সময়সীমা শেষ হওয়ার পরও বিশ্বস্ত সূত্রের খবর, এখনো বিভিন্ন হলে অন্তত ৩০ বিদ্রোহী প্রার্থী তাদের মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করেননি। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্যরা হলেন এসএম হল শাখা ছাত্রলীগের নাট্য ও বির্তকবিষয়ক সম্পাদক রিয়াজ উদ্দিন সোহেল। কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের সমাজসেবাবিষয়ক সম্পাদক পদে প্রার্থী হয়েছেন তিনি। একই হলের উপ-প্রচার সম্পাদক আমির হোসেন হল সংসদের সদস্য প্রার্থী, সহ-সম্পাদক এসএম ফেরদাউস সদস্য পদপ্রার্থী হিসেবে মাঠে রয়ে গেছেন। গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ ছাত্রলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মিজানুর রহমান হাজী মুহাম্মদ মুহসীন হল সংসদের জিএস প্রার্থী, বিজনেস স্টাডিজ অনুষদ শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক হল ছাত্রলীগের দপ্তর সম্পাদক সোলায়মান ইসলাম মুন্না শহীদ সার্জেন্ট জহিরুল হক হল সংসদের ভিপি প্রার্থী, একই হলের জিএস প্রার্থী সাবেক উপ-দপ্তর সম্পাদক তৌফিকুল ইসলাম। কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সাবেক উপ-ছাত্রবিষয়ক সম্পাদক তোহিদুর রহমান জসীমউদ্দীন হল সংসদের জিএস প্রার্থী, হল শাখা ছাত্রলীগের সাবেক সহসভাপতি আশরাফ মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমান হল সংসদের ভিপি প্রার্থী। কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের ক্রীড়া সম্পাদক প্রার্থী তানসেন শেখ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হল শাখা ছাত্রলীগের সংস্কৃতিবিষয়ক উপ-সম্পাদক। মেহেদী হাসান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হল সংসদের রিডিং রুম সম্পাদক প্রার্থী। তিনি একই হল শাখা ছাত্রলীগের প্রচার সম্পাদক। বঙ্গবন্ধু হলের সদস্য প্রার্থী আরমান হোসেন হল শাখা ছাত্রলীগের উপ-তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক। গত কয়েকদিনে ক্যাম্পাসের বিভিন্ন হল ও গুরুত্বপূর্ণ স্থান ঘুরে দেখা গেছে ছাত্রলীগের প্যানেল থেকে নির্বাচনে অংশ নেওয়া প্রার্থীদের অনেকেই পৃথক পৃথকভাবে ভোট চাইছেন, তাদের প্রচার চালিয়ে যাচ্ছেন। ভিপি ও জিএস প্রার্থীর সঙ্গেও তাদের কোনো সমন্বয় নেই। কেন্দ্রীয় সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক ও ঢাবি শাখা সাধারণ সম্পাদক ডাকসুর প্যানেলে গুরুত্বপূর্ণ পদের প্রার্থী হওয়ায় বিভিন্ন হল সংসদ ও কেন্দ্রীয় সংসদের প্রার্থীদের মধ্যে তৈরি হয়েছে সমন্বয়হীনতা। এ ছাড়া বেশিরভাগ হল সংসদেই হল ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকদের প্রার্থী করা হয়নি। নতুনদের প্রার্থী করায় সিনিয়রদের অনেকেই হতাশ। এ ছাড়া প্রার্থী মনোনীত করার ক্ষেত্রে তাদের সঙ্গে কোনো আলোচনা পর্যন্ত করা হয়নি। ফলে এসব নেতাই শুধু নন, তাদের অনুসারী নেতাকর্মীরাও প্যানেল প্রার্থীদের প্রচারকাজে অনেকটাই নিষ্ক্রিয় রয়ে গেছেন। ছাত্রলীগের প্যানেল থেকে কেন্দ্রীয় সংসদের একটি পদের প্রার্থী বলেন, সবাই নিজের আখের গোছাচ্ছে, পুরো প্যানেলের কথা কেউ ভাবছে না। এদিকে প্যানেল থেকে বঞ্চিত স্বতন্ত্র প্রার্থীদের নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়াতে মানসিক চাপ প্রয়োগ এমনকি নির্যাতন করারও অভিযোগ উঠেছে। এর মধ্যে সলিমুল্লাহ মুসলিম (এসএম) হল সংসদের এক স্বতন্ত্র প্রার্থীকে মারধরসহ রাতভর নির্যাতন করার অভিযোগ উঠেছে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে। সূত্রমতে, ওই প্রার্থীকে প্রায় ১৩ ঘণ্টা আটকে রেখে প্রার্থিতা প্রত্যাহারে বাধ্য করা হয়। গতকাল সকাল ১০টার দিকে প্রার্থিতা প্রত্যাহার করে নেন মাহবুবুর রহমান সাজিদ নামের ওই ভুক্তভোগী। তিনি এসএম হল ছাত্র সংসদের সংস্কৃতিবিষয়ক সম্পাদক পদে স্বতন্ত্রভাবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছিলেন। ছাত্রলীগের প্যানেল থেকে এ পদে প্রার্থী মোস্তফা সরকার মিসাদ। জানা যায়, গত শুক্রবার রাত ৯টার দিকে মোস্তফা সরকার মিসাদ, মুজাহিদ, আরিফ, অনিকসহ পাঁচ থেকে সাতজন সাজিদকে অমর একুশে গ্রন্থমেলা প্রাঙ্গণ থেকে ধরে নিয়ে আসেন। পরে হলের ১১১ নম্বর কক্ষে তাকে আটকে রেখে প্রথম দফায় শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন চালানো হয়। এরপর রাত গভীর হলে তাকে যখন পুনরায় নির্যাতন করা শুরু হয়, তখন তিনি মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন এবং প্রার্থিতা প্রত্যাহার করার অঙ্গীকার করেন। এরপর প্রার্থিতা প্রত্যাহারে তাকে দিয়ে আবেদনপত্র লেখানো হয় এবং তাকে নিয়ে যাওয়া হয় সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে। আবেদনটি জমা দেওয়ার পর তাকে ছেড়ে দেওয়া হয়। এ ছাড়া মুহসীন হল, মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমান হল, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হলের বেশ কয়েকজন প্রার্থীকে নানাবিধ চাপ প্রয়োগ করে প্রার্থিতা প্রত্যাহারে বাধ্য করা হয় বলে অভিযোগ রয়েছে। এদিকে প্রতিটি হলে জোর করে স্বতন্ত্র প্রার্থীদের মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করতে চাপ প্রয়োগের প্রতিবাদ জানিয়েছেন স্বতন্ত্র জিএস প্রার্থী এ আর এম আসিফুর রহমান। গতকাল দুপুরে উপাচার্য বরাবর এ সংক্রান্ত একটি লিখিত অভিযোগ জমা দেন তিনি। একই সঙ্গে ভোট গ্রহণের সময়সীমা বাড়ানোরও দাবি জানান তিনি। এ আর এম আসিফুর রহমান এ বিষয়ে গতকাল আমাদের সময়কে বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী হিসেবে প্রত্যেকেরই নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার অধিকার রয়েছে। আমি স্বতন্ত্রভাবে ডাকসু নির্বাচনে সাধারণ সম্পাদক (জিএস) হিসেবে নির্বাচনে অংশ নিচ্ছি। ইতোমধ্যে বিভিন্ন হলের স্বতন্ত্র প্রার্থীরা আমার সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন বৃহত্তর ঐক্য গড়ে তোলার প্রত্যাশায়। মারধর বা চাপ প্রয়োগ করে মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করানোর তীব্র প্রতিবাদ জানান তিনি। বলেন, এটা নির্বাচনী আচরণবিধির সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। এ জন্যই আমি উপাচার্য বরাবর অভিযোগপত্র দিয়েছি যেন দ্রুত এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়। সার্বিক বিষয়ে জানতে ছাত্রলীগ প্যানেলের জিএস প্রার্থী গোলাম রাব্বানীকে ফোন করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি। তবে ছাত্রলীগের নির্বাচন পরিচালনা কমিটির চেয়ারম্যান সঞ্জিত চন্দ্র দাস বলেন, মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারে কারও ওপর জোর খাটানো যাবে না। আমাদের প্যানেলের বাইরে গিয়ে যারা বিদ্রোহী প্রার্থী হয়েছেন, আমরা তাদের বোঝানোর চেষ্টা করেছি যেন সংগঠনের স্বার্থে মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করে নেন। অনেকে প্রত্যাহার করেছেনও। কিন্তু কাউকেই চাপ প্রয়োগ করা হয়নি। তবে যারা বিদ্রোহী প্রার্থী হয়েছেন প্যানেলের বাইরে গিয়ে এবং অনুরোধ করার পরও প্রত্যাহার করেননি, তাদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জানান তিনি।