প্রখ্যাত কবি ও দার্শনিক কাহলিল জিবরানের একটি গল্প আছে। গল্পটি অনেকটা এমনÑ এক লোক মরুভূমির দীর্ঘপথ পাড়ি দিয়ে রাতে এক সরাইখানায় আশ্রয় নেন। আর নিজের ঘোড়াটি বেঁধে রাখেন সরাইখানার বাইরে। সকালে উঠে দেখে ঘোড়াটি চুরি গেছে। তখন উপস্থিত জনতা ওই লোককে নানা অপবাদ দিতে থাকে। কেউ বলে অলস লোকরাই ঘোড়ায় চড়ে; কেউ বলে এভাবে কেউ বাইরে ঘোড়া রাখে…। একপর্যায়ে লোকটি বলে, তোমরা শুধু আমার দোষ দেখছ… যে চুরি করছে তাকে তো কিছু বলছ না! শ্রীলংকায় ইস্টার সানডেতে গির্জা ও বিলাসবহুল হোটেলে সন্ত্রাসী হামলার প্রেক্ষাপটে গল্পটি বেশ প্রাসঙ্গিক। ভয়াবহ ওই হামলার পর থেকে একটি প্রশ্ন বারবার ঘুরপাক খাচ্ছে যেÑ হামলার আগাম সতর্কবার্তা পাওয়ার পরও কেন এ ধরনের হত্যাযজ্ঞ ঠেকানো গেল না? প্রশ্নটি অবশ্যই গুরুতর।আবার এ প্রশ্নের জবাব দেওয়া হচ্ছে এভাবেÑ কিছুদিন আগে প্রেসিডেন্ট সিরিসেনা ও প্রধানমন্ত্রী রনিল বিক্রমাসিংহের মধ্যে যে দ্বন্দ্ব দেখা দিয়েছিল, এই রক্তপাত তারই মাসুল। বিক্রমাসিংহে নিজেও ইঙ্গিত দিয়ে বলেছেন, এ ধরনের সতর্কবার্তা সাধারণত প্রেসিডেন্ট জেনে থাকেন; তিনি নিজে এ বার্তা পাননি। লংকান সরকারও ইতোমধ্যে প্রতিরক্ষাব্যবস্থায় ঘাটতির বিষয়টি স্বীকার করে পদস্থ কর্মকর্তাদের বরখাস্ত করছে। বিষয়টি হয়তো অমূলক নয়। কিন্তু আমরা যদি সরকারের দুর্বল ব্যবস্থপনা বা দ্বন্দ্বের কারণে এত বড় হামলা হয়েছে বলে মনে করি, তা হলে খোদ হামলাকারীদেরই দায়মুক্তি ঘটে। এমনিতে শ্রীলংকা সাম্প্রদায়িক সহিংসতার দেশ নয়। দেশটির দীর্ঘ গৃহযুদ্ধের রক্তাক্ত ইতিহাস থাকলেও সেখানে বড় ধরনের সাম্প্রদায়িক সহিংসতার ঘটনা নেই। আর যে মুসলিম সম্প্রদায়ের সদস্যরা হামলা চালিয়েছে, তাদের উপস্থিতি দেশটিতে মাত্র ৯.৭ শতাংশ। এর মধ্যে পাকিস্তান থেকে বিতাড়িত আহমদিয়া সম্প্রদায়ের মুসলমানও রয়েছে। আবার হামলার পর স্থানীয় যে জঙ্গি সংগঠনকে দায়ী করা হচ্ছে, সেই ন্যাশনাল তাওহিদ জামাতের (এনটিজে) সক্ষমতা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। এর আগে দলটির বিরুদ্ধে শুধু বৌদ্ধমূর্তি ভাঙার অভিযোগ রয়েছে। অন্যদিকে হামলার দায় স্বীকার করেছে তথাকথিত ইসলামিক স্টেট বা আইএস। কিন্তু তাদের এ ধরনের দায় স্বীকার নিয়েও সন্দেহের বিস্তর অবকাশ রয়েছে। এর আগে বেশ কিছু হামলার ক্ষেত্রে সরাসরি কোনো ধরনের সম্পৃক্ততা ছাড়াই আইএসকে দায় স্বীকার করতে দেখা গেছে। আর এ হামলা এমন সময় ঘটল, যখন আইএসের নিজের অস্তিত্ব নিয়েই টানাটানি। তাদের মূল ঘাঁটি সেই ইরাক ও সিরিয়া থেকেই সমূলে বিতাড়িত হয়েছে। তবে আইএসের মতাদর্শে দীক্ষা নিয়ে এমন হামলা চালানো অসম্ভব কিছুই নয়। শ্রীলংকায় জঙ্গি হামলায় আরও একটি বিষয় আলোচনা হচ্ছে, তা হলোÑ এটি নিউজিল্যান্ডের ক্রাইস্টচার্চে হামলার প্রতিশোধ কিনা। লংকান এক মন্ত্রী নিজেও এমনটা মনে করেন। কিন্তু নিউজিল্যান্ড কর্তৃপক্ষ বলছে, তাদের কাছে এ ধরনের কোনো তথ্য নেই। তবে একটি সহিংসতা যে আরেকটি সহিংসতার জন্ম দেয়, তা মিথ্যা নয়। ক্রাইস্টচার্চে যখন হামলা হলো তখন আমরা দেখালামÑ উগ্র শে^তাঙ্গবাদী টারান্ট হামলা চালালেও এর পেছনে মূল ধারার রাজনীতিকে দায়ী করেছিলেন বিশ্লেষকরা। সেখানে নাম এসেছিল মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পেরও। বলা হয়েছিল, ট্রাম্প ক্ষমতায় আসার পর শে^তাঙ্গবাদ যেভাবে উগ্রভাবে বিস্তার লাভ করছে, ক্রাইস্টচার্চে হামলা সেটারই নির্মম পরিণতি। আর রাষ্ট্রনায়কদের এমন উসকানিমূলক ভূমিকা যে জাতিগত বিদ্বেষ ছড়ায়, তা বলাই বাহুল্য। এবার আসা যাক শ্রীলংকায় হামলাকারী কারা? তদন্তে বেড়িয়ে এসেছে ৯ জন হামলাকারী সবাই শিক্ষিত, মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্ত পরিবারের সন্তান এবং বয়সে তরুণ। তাদের মধ্যে একজন নারীও রয়েছেন। লংকান প্রধানমন্ত্রী বিক্রমাসিংহে সিএনএনকে বলেছেন, বিদেশে পড়–য়া শিক্ষিত তরুণরা কীভাবে এত নৃশংস হতে পারল, তাতে তিনি হতভম্ব। এর জবাব দিয়ে সংবাদমাধ্যম গার্ডিয়ান বলছেÑ এটি এখন আর অবাক হওয়ার মতো বিষয় না। এর ইতিহাস বেশ পুরনো। গত শতকের সত্তরের দশকে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে তরুণ-তরুণীরা সহিংস তৎপরতা শুরু করে। জার্মানি, জাপান, ইতালি এবং যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশগুলো সেসব সহিংসতার সাক্ষী হয়ে আছে। এর ধারাবাহিকতায় আশির দশক বা নব্বই দশকের শুরুর দিকে আত্মঘাতী হামলার প্রবণতা দেখা যায়। এর পর ইসলামপন্থি বিভিন্ন সংগঠনের মধ্য দিয়ে এটি ব্যপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে। ২০১৬ সালে ঢাকায় হলি আর্টিজানে হামলাকারীদের পরিচয় দেখলেও দেখা যায় তারাও শিক্ষিত এবং বয়সে তরুণ। কাজেই যে বা যারা নিজেকে ‘শেষ’ করে দিয়ে নিজের ‘লক্ষ্য পূরণ’ করতে চায়, তাদের রুখতে রাষ্ট্র ও সমাজ নির্মাতাদের নতুনভাবে ভাবা দরকার। তাই কে বা কারা হামলা করছেÑ এটি যতো জরুরি প্রশ্ন, তার চেয়েও বেশি জরুরি প্রশ্ন হলো কেন অথবা কোন পরিস্থিতিতে লোকজন আত্মঘাতী হচ্ছে, শতশত নিরপরাধ মানুষ হত্যা করছেÑ সেই উত্তরের সন্ধান করা।ক