বিরোধী শিবিরে বিরোধ

ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের প্রধান রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ হিসেবে বিবেচিত বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০-দলীয় জোট এবং একাদশ সংসদ নির্বাচনের আগে গঠিত জাতীয় ঐক্যফ্রন্টভুক্ত দলগুলোর মধ্যে একের পর এক সংকট সৃষ্টি হচ্ছে। সংকট সৃষ্টি হচ্ছে জোট ও ফ্রন্টভুক্ত দলগুলোর অভ্যন্তরেও। নিজেদের ভেতরের অবিশ্বাস আর অস্থিরতার কারণে একের পর এক ইস্যু এলেও সরকারকে কাবু করতে পারছে না বিরোধী শিবির। এক যুগেরও বেশি সময় ধরে ক্ষমতার বাইরে বিএনপি। এরই মধ্যে দুর্নীতি মামলায় আদালতের রায়ে দলের চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া কারাবন্দি; তার অবর্তমানে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হিসেবে যার হাতে দলের নেতৃত্ব, সেই সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানও কারাদ-াদেশ মাথায় নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে দেশের বাইরে অবস্থান করছেন। উপরন্তু কেন্দ্রীয় তো বটেই, বিএনপির তৃণমূল পর্যায়ের নেতাকর্মীদের মধ্যেও অনেকেই জেলে।যারা বাইরে আছেন, তাদের মাথার ওপর ঝুলছে অসংখ্য মামলার খড়গ। সব মিলিয়ে বেশ নাজুক হয়ে পড়েছে রাজনীতির মাঠে প্রধান বিরোধী দল বিএনপি। এমন ক্রান্তিকালে দলে প্রভাব বিস্তার, বিভিন্ন ইস্যুতে মতভিন্নতা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ ইত্যাদি নিয়ে নেতাদের মধ্যে ক্রমেই বাড়ছে দ্বন্দ্ব, ছড়িয়ে পড়ছে অস্থিরতা। এরই মধ্যে একাদশ সংসদ নির্বাচনে বিজয়ী দলের এক সাংসদের শপথগ্রহণ নিয়ে দলের ভেতরেই সৃষ্টি হয়েছে নতুন টানাপড়েন।এদিকে বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০-দলীয় জোট থাকলেও এর কোনো কার্যক্রম নেই। এ জোটের অন্যতম শরিক জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধ ইস্যুতে অনেক আগে থেকেই বিএনপির দুরত্ব সৃষ্টি হয়েছে। তদুপরি একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে নির্বাচনী জোট হিসেবে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠিত হওয়ার পর জামায়াত এ মোর্চায় অনেকটাই অপাঙক্তেয় হয়ে পড়েছে। এদিকে জামায়াতের মধ্যে অনেক দিন ধরে চলা গৃহবিবাদে যোগ হয়েছে আনুষ্ঠানিক মাত্রা। গতকাল জামায়াতের সংস্কারপন্থি নেতারা নতুন দল গঠনের ঘোষণা দিয়েছেন। অন্যদিকে ঐক্যফ্রন্টের সবচেয়ে প্রভাবশালী নেতা ড. কামাল হোসেন প্রতিষ্ঠিত গণফোরামেও দলীয় দ্বন্দ্ব প্রকাশ্যে চলে এসেছে দলটি থেকে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিজয়ী দুই নেতা সংসদ সদস্য হিসেবে শপথ নেওয়ার পর। বিএনপির অনেকেই মনে করেন, এতে ‘নীরব সংকেত’ রয়েছে ড. কামালের। এ নিয়ে ঐক্যফ্রন্টের অন্যতম দুই দল বিএনপি ও গণফোরামের মধ্যেও সৃষ্টি হয়েছে দূরত্ব। সব মিলিয়ে সরকারবিরোধী শিবিরে জোটগত অর্থে এক দলের সঙ্গে অন্য দলের তো বটেই, দলের অভ্যন্তরেও অবিশ্বাস আর অস্থিরতা চরম আকার ধারণ করেছে। এর প্রভাব পড়েছে কেন্দ্র থেকে তৃণমূল পর্যন্ত; বিরোধী শিবিরের নেতাকর্মীদের গ্রাস করছে হতাশা। বিএনপির একাধিক নীতিনির্ধারকের সঙ্গে আলাপকালে জানা গেছে, ক্ষমতার পালাবদল না হওয়ায় নেতাকর্মীদের মধ্যে হতাশা আছে ঠিক। তবে এর চেয়েও কঠিন সত্য, সরকার তাদের বিভিন্ন উইংকে ব্যবহার করে বিরোধী নেতাকর্মীদের ওপর নির্যাতন চালাচ্ছে। মামলা দিয়ে তাদের আদালতের কাঠগড়ায় ব্যস্ত রাখছে; বাড়িয়ে দিচ্ছে শঙ্কা-উৎকণ্ঠা। নেতাদের বিরুদ্ধে মামলার সংখ্যা এত বেশি যে, স্বাভাবিকভাবে বেঁচে থাকতে অনেকেই রাজনীতিতে নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েছেন। যারা এখনো সক্রিয়, তাদের মধ্যে রয়েছে দলীয় ক্ষমতা নিয়ে ব্যাপক দ্বন্দ্ব। কেউ প্রভাব খাটাতে আর কেউ প্রভাব ধরে রাখতে ব্যস্ত। নীতিনির্ধারকরা মনে করছেন, ‘লোভের’ বশবর্তী হয়ে সাংসদ হিসেবে শপথ নেওয়া হচ্ছে, ভবিষ্যৎ রাজনীতির কথা বিবেচনা করা হচ্ছে না। তারা মনে করেন, যিনি শপথ নিয়েছেন, তিনি ‘কিছু’ পাওয়ার লোভে নিয়েছেন; একই কারণে আরও কয়েকজনও শপথ নিতে পারেন। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বরচন্দ্র রায় আমাদের সময়কে বলেন, দলে অনেক মত থাকলেও মতের অমিল নেই। গণতন্ত্র আছে বলেই গণতান্ত্রিকভাবে নেতারা তাদের মতামত দিচ্ছেন। তিনি বলেন, রাজনীতির বিভিন্ন মোড় থাকে। একেক সময় রাজনীতি একেক দিকে মোড় নেয়। অনেক সময় রাজনীতি এমন পর্যায়ে থাকে, যখন জোটের রাজনীতির গুরুত্ব কম যায়। আবার কখনো কখনো জোটের রাজনীতিও অনেক গুরুত্বপূর্ণ হয়ে পড়ে। ঐক্যফ্রন্টের মধ্যে শপথগ্রহণ নিয়ে কোন্দল প্রকাশ্যে এসেছে শুক্রবার। ৮ বছর পর গণফোরামের কেন্দ্রীয় বিশেষ কাউন্সিলে দলীয় সিদ্ধান্ত অমান্য করে সাংসদ হিসেবে শপথগ্রহণ করা মোকাব্বির খানের উপস্থিতি নিয়ে দলটির নেতাকর্মীরা বিভক্ত হয়ে পড়েন। এ কারণে নেতাদের অনেকে প্রকাশ্যে কাউন্সিলস্থল ত্যাগ করেন। বিএনপি তথা ২০-দলীয় জোটের অধিকাংশ নেতাকর্মীর ধারণাÑ গণফোরামের সুলতান মনসুর ও মোকাব্বির খানের শপথ নেওয়ার নেপথ্যে দলটির সভাপতি ড. কামাল হোসেনের ‘নীরব সংকেত’ কাজ করেছে। খোদ গণফোরামেরই একাধিক নেতা মনে করেন, ড. কামাল হোসেনের সবুজ সংকেত না পেয়ে এ দুজন শপথ নেননি। গণফোরাম থেকে নির্বাচিত দুই সাংসদের শপথ-উত্তর ড. কামালের আচরণও যথাযথ মনে হচ্ছে না বিএনপি নেতাদের কাছে। এ নিয়ে গতকাল গণফোরাম নেতারা প্রকাশ্যে ড. কামালের সমালোচনা করলেও ঐক্যফ্রন্ট টিকিয়ে রাখার স্বার্থে বিএনপি এখনো মুখ খোলেনি। গণফোরাম অবশ্য বিভিন্ন সমালোচনার জেরে গতকাল মোকাব্বির খানকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দিয়েছে। দু-একদিনের মধ্যে দলের ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠক হতে পারে। এর পর শপথগ্রহণকারী নেতাদের দল থেকে বহিষ্কার করা হতে পারে বলে বিশ্বস্ত সূত্রের খবর। জানতে চাইলে গণফোরাম সাধারণ সম্পাদক মোস্তফা মহসিন মন্টু আমাদের সময়কে জানান, দলের কাউন্সিল শেষ হয়েছে। এখন জ্যেষ্ঠ নেতারা বসে সবার মতামতের ভিত্তিতে সমস্যার সমাধান করবেন। তবে বিরোধী শিবিরের প্রধান দল বিএনপিতে সংকট এখন বেশি। কারণ দলটির হয়ে একাদশ সংসদ নির্বাচনে বিজয়ী এক নেতা সাংসদ হিসেবে শপথ নিয়ে বিএনপিকে বিব্রতকর অবস্থায় ফেলেছে। সরকার তাদের সংসদ সদস্যদের নিয়ে যে ‘রাজনীতি’ করছে, তা ঠিকভাবে সামাল দিতে পারেনি বিএনপির নীতিনির্ধারকরা। এ জন্য শীর্ষপর্যায়ের নেতারা পরস্পরকে দোষারোপও করছেন। কারও কারও মতে, নীতিনির্ধারকরা আগে থেকে সক্রিয় হলে বিষয়টি ভালোভাবে সামাল দেওয়া যেত। কিন্তু কাউকেই আগে থেকে কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করতে দেখা যায়নি। জানা গেছে, বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার প্যারোলে মুক্তি নিয়ে দলের মধ্যে দ্বিমত আছে। একটি অংশের মতে, দলে অনেক ভুল সিদ্ধান্ত নেওয়া হচ্ছে এবং সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে সমন্বয় নেই। যার কারণে দলের প্রয়োজনে যে কোনো উপায়ে চেয়ারপারসনের বাইরে থাকা দরকার। কেউ কেউ মনে করেন, খালেদা জিয়া কারাগারে যাওয়ার পর বেশ কয়েকজন জ্যেষ্ঠ নেতা গুরুত্ব হারিয়েছেন। দলে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে তাদের মতামত নেওয়া হচ্ছে না, মতামত নেওয়া হলেও তা প্রাধান্য পাচ্ছে না। ওই অংশটি প্যারোলে হলেও খালেদা জিয়ার মুক্তি চান, যাতে দলের সকল পর্যায়ে ‘ভারসাম্য’ তৈরি হয়। এর বাইরেও একটি অংশের মতামত সম্পূর্ণ ভিন্ন। তারা মনে করেন, খালেদা জিয়া প্যারোলে মুক্তি নিলে তার আপসহীন চরিত্রে ছেদ পড়বে। বিএনপি চেয়ারপারসন ও তার দলের রাজনৈতিক মৃত্যু ঘটবে। এর চেয়ে বন্দি খালেদা জিয়াই অনেক শক্তিশালী। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ বলেন, বর্তমান প্রেক্ষাপটে সরকার বিএনপিকে ভাঙতে চায় না। তারা বিএনপিকে নিঃশেষ করে দিতে চায়। কিন্তু এটা কোনোদিন সম্ভব হবে না। কারণ এ সরকারের দ্বারা লাখ লাখ মানুষ নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। অনেকেই তাদের মা, বোন, সন্তান হারিয়েছেন। ২৬ লাখ মামলা হয়েছে। এদের ওপর যেভাবে অত্যাচার ও নির্যাতন হয়েছে, তারা কোনোদিন জাতীয়তাবাদী দলকে ভুলতে পারবে না। অবশ্য সবকিছু ছাপিয়ে জামায়াতের ভেতরের দ্বন্দ্ব প্রকাশ্যে চলে আসা নিয়ে আলোচনা হচ্ছে সর্বাধিক। জামায়াত থেকে সদ্য বহিষ্কৃত শিবিরের সাবেক সভাপতি মজিবুর রহমান মঞ্জু কয়েক মাসের মধ্যে নতুন রাজনৈতিক দল গঠনের ঘোষণা দিয়েছেন। জানা গেছে, জামায়াতের মতাদর্শ নিয়ে দলের ভেতরে ক্ষুব্ধ একটি অংশ সংস্কারের দাবি তুলেছে। ওই অংশের অনেকেই নতুন দলে যোগ দিতে পারেন। দলের পদত্যাগী নেতা আবদুর রাজ্জাক জামায়াতের আদর্শের সঙ্গে ভিন্নতা পোষণ করে দল ছেড়েছিলেন। মঞ্জুর এ উদ্যোগের সঙ্গে তার নেপথ্য সম্পৃক্ততা থাকতে পারে, ধারণা করা হচ্ছে। একটি সূত্র জানিয়েছে, সংস্কারপন্থিদের নিয়ে জামায়াতের শীর্ষপর্যায়ে বেশ উত্তাপ ছড়িয়ে পড়েছে। তাদের ঠেকাতে দল যেমন কঠোর হতে যাচ্ছে, তেমনি সংস্কারপন্থিরাও সংস্কার ইস্যুতে সরব হওয়ার আভাস দিচ্ছেন। পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে জামায়াতের বেশ কয়েকজন নেতা দলের আদর্শিক ‘গুরুদের’ সঙ্গে যোগাযোগ করছেন। লন্ডনে জামায়াতের সংগঠন খুবই শক্তিশালী। দলীয় ফান্ডসহ নানা কারণে জামায়াতের বিদেশ সংগঠন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সেখানে তাদের মতাদর্শের লোকদের ঠিক রাখতে জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল শফিকুর রহমান মালয়েশিয়া, সৌদি আরব ও লন্ডন সফর করেছেন। সংস্কারপন্থিরাও বিদেশ সংগঠনের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রেখে জামায়াতকে ‘আধুনিক সংগঠনে’ রূপ দিতে কাজ করে যাচ্ছেন।